ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুতে রেকর্ড, চিকিৎসকরা যা বলছেন

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর বিস্তার এ বছর ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মৃত্যুহারও আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চলমান এ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা চলতি বছরে একদিনে সর্বোচ্চ। এনিয়ে চলতি বছর মোট মারা গেছেন ১২৭ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার ৫৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন আর বর্ষা মৌসুমের আতঙ্ক নয়। এর ভয়াবহতা দিনদিন বাড়ছে। এটি মোকাবিলায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর তৎপরতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ব্যাপকভাবে সচেতন হতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষা পূর্ববর্তী জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৫৫টি ওয়ার্ডেই এ বছর এডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকিপূর্ণ। গত বছর জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২ হাজার ৬৬০ জন, মারা গিয়েছিল ১০ জন। এ বছর জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ২২ জন, আর মারা গেছেন ৮০ জন। জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৯৫৬ জন, মারা গেছেন ৩৪ জন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ড. আতিকুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু এখন আর সিজনাল নেই, সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ে। গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ জুন মাস থেকে শুরু হয়েছিল। চলতি বছর মে মাস থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর চৌধুরী বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে বছরব্যাপী নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে, শুধু জেল-জরিমানা আর জনসচেনতনা বাড়িয়েই কাজ হবে না। সঠিকভাবে জরিপ চালিয়ে দক্ষ জনবল দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

এডিস মশাবাহিত রোগে শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এবারই এত দ্রুত মৃত্যুহার ছাড়িয়েছে। এ বছর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগীও হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছে।

হাসপাতালটির পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, আমাদের হাসপাতালে যারা মারা গেছেন, তারা অনেক দেরিতে হাসপাতালে এসেছেন। তাদের আইসিইউতে পাঠাতে হয়েছে। অনেক রোগী এমন পর্যায়ে হাসপাতালে আসেন যখন আর কিছুই করার থাকে না। আমাদের এখানে যারা মারা গেছেন তার ৯৫ শতাংশই আইসিইউতে ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের অবস্থাই জটিল ছিল।

তিনি বলেন, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি হওয়ার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ দিয়ে নির্ণয় করতে না পারা। এবার কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রম দেখা যাচ্ছে। আমরা অনেক রোগী পেয়েছি, যারা ডায়রিয়া নিয়ে এসেছে। অনেকে বমি নিয়েও এসেছে। পেট ও বুকে পানি জমেছে, হাত ও পা ফুলে গেছে এমন রোগীও এসেছে। মস্তিষ্কের প্রদাহ, খিঁচুনি নিয়ে অনেক রোগী এসেছে। অনেকের সেন্স আছে কিন্তু ব্লাড প্রেসার রেকর্ড করা যাচ্ছে না। জ্বর অনেক সময় থাকে, অনেক সময় থাকে না। অনেক সময় রোগীরা ভাবে তারা ভালো আছেন।

হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। বর্ষার শুরু থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহের ধারায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ চলতে থাকলে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, শক সিন্ড্রোমের কারণে বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। তাই অবহেলা না করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ১০৩ থেকে ১০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস জ্বর, ব্যথা, গায়ে র্যাশ হওয়া, প্লাটিলেট কমে যাওয়ার মতো ডেঙ্গুর সাধারণ লক্ষণগুলো এবার বদলে গেছে। এবার ডেঙ্গুর তেমন কোনো লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে না। যেহেতু ট্রিপিক্যাল লক্ষণ না থাকায় মানুষ বুঝতেই পারে না। এ জন্য তারা টেস্ট করতেও দেরি করে। আর দেরি হওয়ায় সিরিয়াস অবস্থায় চলে যায়, তখন রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়। যারা জটিল রোগে ভুগেছেন, কিডনি-হার্ট-লিভার-ক্যানসারের রোগী, তারাই বেশি মারা যাচ্ছেন। এবার যাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে তাদের অধিকাংশই আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, এখন সামান্য জ্বর, সর্দি-কাশি, শরীর বা মাথাব্যথা হলেই দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এতে পজিটিভ হলে চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা যাবে, জটিলতা এড়ানো যাবে। কারও ডেঙ্গু হলে তাকে পাঁচ থেকে ছয় দিন মশারির ভেতরে রাখতে হবে, না হলে তার মাধ্যমে আরেকজন আক্রান্ত হবে। এ জন্য আর্লি ডায়াগনসিস জরুরি। ডেঙ্গু হলে তরল খাবার বারবার খেতে হবে। খেতে না পারলে, বমি-পাতলা পায়খানা হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কারও জ্বর হলেই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। আর চিকিৎসক এবং রোগীর স্বজনদের ডেঙ্গুর ঝুঁকিগুলো জেনে রাখা দরকার। কালো পায়খানা, যেকোনো ধরনের রক্তপাত, তীব্র পেটব্যথা, তিন-চারবারের বেশি বমি, মুখে খেতে না পারা, তিন-চারবারের বেশি পাতলা পায়খানা, ছয় ঘণ্টা ধরে প্রস্রাব না হওয়া, প্রচণ্ড দুর্বলতা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ উপসর্গ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.