চট্টগ্রামে বধ্যভূমি কমপ্লেক্স দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি

বেহাত হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামে একাত্তরের বৃহত্তম ‘জল্লাদখানা’ হিসেবে পরিচিত পাহাড়তলী বধ্যভূমি কমপ্লেক্স এলাকায় খাসজমি ছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও রয়েছে। এ কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে জমি পুনরুদ্ধারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এক ধরনের অনীহা রয়েছে। তাই সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল সরকারে থাকার পরও থমকে আছে পাহাড়তলী বধ্যভূমি স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণযজ্ঞ। এমন বাস্তবতায় স্মৃতি কমপ্লেক্স বাস্তবায়নে ফের আন্দোলনে নেমেছে পাহাড়তলী বধ্যভূমি স্মৃতি রক্ষা পরিষদ। আগামী ২ মার্চ সকাল দশটায় আদালত ভবনের নিচে ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ স্মৃতিসৌধের সামনে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার সদস্যদের অবস্থান শেষে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ পরিবারগুলোর অভিযোগ- দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ সত্বেও একাত্তরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ নিরীহ বাঙালিদের নৃশংস হত্যাকান্ডের স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের গরজবোধ করছেন না কেউই। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও বধ্যভূমি সংরক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনীহা বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণের মানুষের মধ্যে নিদারুণ অস্বস্তি তৈরি করেছে। বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়তলীর জাকির হোসেন রোডে পৌনে দুই একর ভূমিতে অবস্থিত বধ্যভূমি সংরক্ষণে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করে ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়েছিল। পরে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীনর চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি বাতিল করে টাকা ফিরিয়ে নেয়। আর তখন জমিটি কিনে নেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি) কতৃর্পক্ষ। জমি কেনার পর ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু করে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিন, মিলি রহমানসহ আট বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট রিটটি নিষ্পত্তি করে দিলে আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগ ওই জমিতে বধ্যভূমি রয়েছে কি না, তা জানতে একটি কমিটি গঠন করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লার নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের আদেশ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো ডিসিই এই বধ্যভূমি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর। বর্তমানে বধ্যভূমি এলাকায় একটা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সেটিও ধুলায় ধুসর ও মলিন হয়ে আছে। ঘাস, আগাছা, ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে চারপাশ। মূল বধ্যভূমি যেখানে, সেখানে ইউএসটিসির ইস্পাতের তৈরি একটি অর্ধনির্মিত ভবন দাঁড়িয়ে আছে।
বধ্যভূমি রক্ষা পরিষদের শীর্ষ কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, আদালতের নির্দেশনার পরও কেবলমাত্র প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাবে পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বধ্যভ‚মির মত মহান মুক্তিযুদ্ধের অতি সংবেদনশীল স্মৃতিবিজড়িত এই কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরও বেহাত হয়ে যাওয়া বধ্যভুমির জমি পুনরুদ্ধারে কারও কোনও নড়াচড়া নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, রায়েরবাজারের পর দেশের বৃহত্তম এই বধ্যভুমি সংরক্ষণে কেউই কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। জাতি হিসেবে এ বড় লজ্জার।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এই বধ্যভূমিতে অন্তত পাঁচ হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। একাত্তরের ১০ নভেম্বর প্রয়াত অধ্যাপক ড. গাজী সালেহউদ্দিনের বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা আলী করিমসহ একই পরিবারের চারজনকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছিল। একই দিন পাঁচ হাজার নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে এখানে জবাই করা হয়েছিল বলে আদালতের শুনানিতে বিভিন্ন সাক্ষীর বক্তব্যে উঠে আসে। বধ্যভূমিটি যাতে সংরক্ষণ করা হয়, সে জন্য আইনি লড়াই করতে হয়েছিল। আইনি লড়াই অনেক আগে শেষ হলেও অবসান হয়নি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার। যার কারণে এখনও অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে একাত্তরে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ‘জল্লাদখানা’খ্যাত এই বধ্যভূমি।
আদালতের রায়ের আট বছর পর পাহাড়তলী বধ্যভূমির জন্য বরাদ্দকৃত এক দশমিক ৭৫ একর জমি পুনরুদ্ধারপূর্বক কমপ্লেক্স বাস্তবায়নের দাবিতে পুনরায় আন্দোলনে নেমেছে পাহাড়তলী বধ্যভূমি কমপ্লেক্স বাস্তবায়ন পরিষদ। মাঝখানে বেশ কিছুদিন নীরব থাকার পর ফের সরব হয়েছেন পরিষদের কর্মকর্তরা। গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিকালে পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদী সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। পরিষদের আহব্বায়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা কামাল যাত্রা’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত পূর্বঘোষিত এই প্রতিবাদী সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য পরিষদের সদস্যসচিব মোহাম্মদ শাহাবউদ্দিন আঙ্গুর। সমাবেশে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম, নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী, নারীনেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু, নাট্যজন মাশরুজ্জামান মুকুট, গণঅধিকার চর্চা কেন্দ্রের প্রতিনিধি ভাস্কর চৌধুরী, পাহাড়তলী বধ্যভূমি রক্ষা পরিষদের সদস্য আবু সুফিয়ান প্রমুখ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.