রাফাহ—একটি নাম, যা আজ শুধুই একটি ভূখণ্ড নয়, এটি এক জীবন্ত ট্র্যাজেডি, এক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। এই ভূমি একদিন ছিল শান্তি ও মানুষের জীবনের স্পন্দনে মুখর, আজ তা পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর ধ্বংসস্তূপে। গাজা উপত্যকার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এই ছোট্ট শহরটি বর্তমানে এক লক্ষ সতেরো হাজার অবরুদ্ধ, নির্যাতিত, আশ্রয়হীন মানুষের আশ্রয়স্থল—তবে সেই আশ্রয় এখন কেবল ধ্বংস, আগুন, আর কান্নার প্রতিধ্বনি।

রাফাহ ফিলিস্তিনের দক্ষিণে, মিশর সীমান্তঘেঁষা একটি শহর, যার নাম পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাসেও। এটি প্রাচীন কালে ফারাওদের আমলে এবং রোমান যুগে সামরিক ও বাণিজ্যিক পথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এটি গাজা উপত্যকার অংশ হিসেবে পরিচিত। ইসরায়েলি আগ্রাসন ও অবরোধ নীতি রাফাহকে মানবিক বিপর্যয়ের এক চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে।
রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং, যা গাজা ও মিশরের মধ্যে একমাত্র প্রবেশদ্বার, তা বহু বছর ধরে এক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো তা খুলে দেওয়া হয়, কখনো আবার বন্ধ করে রেখে ফিলিস্তিনিদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আজ এই রাফাহ হয়ে উঠেছে সেই পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি, যেখানে মানবতা পরাজিত, সভ্যতা নতমস্তক। শিশুর কান্না, মায়ের আর্তনাদ, পিতার নিরব প্রতিবাদ—এই শব্দগুলো বাতাসে মিশে গেছে। গৃহহীন, খাদ্যহীন, ওষুধবিহীন মানুষেরা এখন কেবল মহান রবের দিকে চেয়ে থাকে। “আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না” (সূরা যুমার, ৩৯:৫৩)।

আমরা বিশ্বাস করি, এই ভূমি শুধু অশ্রু ও রক্তে রঞ্জিত নয়, বরং এটি সেই ময়দান, যেখানে সংঘটিত হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ—মালহামাতুল কুবরা। রাসূলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন সেই দিন সম্পর্কে, যখন দাজ্জালের ফিতনা রুখতে ঈসা (আ.) ও মাহদী (আ.)-এর বাহিনী ঐক্যবদ্ধ হবে।

“আর তারা যখন গাছের পেছনে লুকাবে, তখন গাছ বলবে: ‘হে মুসলিম! আমার পেছনে একজন ইয়াহুদি লুকিয়ে আছে, এসো তাকে হত্যা করো।’” — (সহীহ মুসলিম-২২৩৯)
এই ভূমিতেই ইয়াজুজ-মাজুজের দমন হবে, এই ভূমিতেই কুফর ও জুলুমের পতন ঘটবে। হয়তো আজ আমরা সেই দিনের পূর্বরূপ দেখছি—একটি বিশ্বজাগরণ, একটি চেতনার উদয়, যার বীজ রোপিত হচ্ছে রক্তাক্ত শিশুদের আর্তনাদে, বিধ্বস্ত নারীদের নিরব চোখের ভাষায়।

হে আর-রহমান! হে প্রতিশোধ গ্রহণকারী মালিক! তুমি কি দেখো না রাফাহের ছিন্নভিন্ন শরীর? তুমি কি শুনো না সেই দগ্ধ পিতার কান্না, যে তার সন্তান হারিয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে?
“তুমি কখনোই মনে কোরো না যে, আল্লাহ জালিমদের কর্ম থেকে গাফেল আছেন।” (সূরা ইবরাহিম, ১৪:৪২)
হে আল্লাহ! এই যালিমদের বিরুদ্ধে তুমি তোমার গজব বর্ষণ করো, নির্যাতিতদের জন্য খুলে দাও তোমার রহমতের দরজা। আমাদের জীবনে সেই দিনের কোনো নিদর্শন দেখাও, যেদিন তুমি পৃথিবীর ইতিহাসে লিখে দেবে, “জালিমেরা পরাজিত হয়েছে, ন্যায়ের বিজয় ঘটেছে।”

রাফাহ এখন কোনো ভূগোলের নাম নয়, এটি একটি আত্মার আর্তনাদ। আমরা যারা বাইরে বসে নিরব দর্শক, আমাদের প্রত্যেকের উচিত অন্তত হৃদয়ে তাদের জন্য ব্যথা অনুভব করা, দোআ করা এবং যথাসাধ্য সচেতনতা তৈরি করা। এই ধ্বংসস্তূপ থেকে একদিন উদয় হবে নতুন সূর্য, ইনশাআল্লাহ—সেই প্রতিশ্রুত বিজয়ের আলো।

লেখক: আকতার কামাল মহসিন
কর্মচারী, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম।

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন