শেষ পথে - মীরাতুল নিহা
শেষ পথে - মীরাতুল নিহা

শেষ পথে – মীরাতুল নিহা


পর্ব-১ এক নিমিষেই কাঁচি দিয়ে কেটে ফেললো চারু। হাতে থাকা লম্বা বিনুনিটার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েদের নাকি লম্বা চুল খুব শখের। চারুরও তাই ছিলো। তবে কি একবারও বুক কাঁপলো না ? কাঁপলে নিশ্চয়ই এই বড়ো চুলগুলো নির্দ্বিধায় কাটতে পারতো না! আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। ছোটো চুলে বড্ড বেমানান লাগছে তাকে। কথায় আছে না “কেশেই বেশ?” চারু.  অনুভূতিহীন। কোনোকিছুই তাকে স্পর্শ করছে না।  পলকহীন ভাবে আর্শিতে নিজেকে দেখে একটু করে মুচকি হাসলো। এই সুন্দর কালো লম্বা চুলগুলোর জন্যই তো শাওন চারুকে পছন্দ করেছিলো। এখন শাওনের কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে? শাওনের কথা ভাবতে ভাবতেই এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠে। ভয়ে আচমকাই বুকটা ধ্বক করে উঠে!  রুম থেকে বের হয়ে রুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলতেই স্বামী শাওন শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ভেতরে ঢুকলো। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে শাওনকে। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে! কয়েকদিন ধরেই বেশ গরম পড়ছে। চারু আর দেরি না করে ফ্যান ছেড়ে দেয় ড্রয়িং রুমের। শাওনের বিশ্রামের জন্য।  শাওনের নজর এখনো পুরোপুরিভাবে তার স্ত্রীর  দিকে পড়েনি। স্বামীকে এরকম অবস্থায় দেখে চারুর খুব মায়া লাগলো।

“গরম লাগছে খুব? লেবুর শরবত করে দিই?”

“হ্যাঁ পারলে একটু করে দাও তো! গরমে খুব তেষ্টা পেয়েছে।”

কথাখানা বলেই শাওনের নজর যায় চারুর দিকে। কোমর সমান লম্বা চুলগুলো ঘাড়ে সমান এসে পড়েছে! বিষয়টা নজরে আসতেই বললো,

“তোমার লম্বা চুল! এ কি অবস্থা করেছো!”

শাওনের কথায় চারু মুচকি হেঁসে প্রতিত্তোর করে,

“কেটে ফেলেছি। বর্তমান যুগে এতো লম্বা চুল কারো দেখিই না।”

“সেজন্য কেটে ফেলবে?”

“হ্যাঁ। তাছাড়া অনেকেরই আবার ছোটো চুল পছন্দ দেখেছি বুঝলে?”

শাওন এবার বেশ রাগত কণ্ঠেই  বলে,

“তোমার যা ইচ্ছে!”

“হ্যাঁ মানুষের ইচ্ছে হলেই তো ইচ্ছানুযায়ী সব কিছু করে।”

“সে তো জলজ্যান্ত তোমাকেই দেখতে পাচ্ছি চারু! নিজের ইচ্ছে পূরণ করেছো চুলগুলোর সাথে!”

কথায় কথা বাড়বে দেখে শাওনের কথার প্রেক্ষিতে আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। শরবতের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র চিনির বয়াম সবকিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হুট করেই বাম হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা চোখের পানি গুলো মুছে নিলো সযত্নে। এই চোখের পানির কারণ বোধহয় লম্বা চুলগুলোর জন্যই! নিজের হাতেই নিজের আনন্দকে শেষ করলো চারু।  শরবত বানানো শেষ করে সোফায় বসে থাকা শাওনের কাছে শরবতের গ্লাস নিয়ে যায়।

“তোমার শরবত। ক’টা বরফের টুকরোও দিয়েছি। ঠান্ডা লাগবে।”

“আহ্ চারু! জানো না আমার ঠান্ডার ধাঁচ আছে? পণ্ডিতি করে বরফ কেনো দিয়েছো? ফ্যান তো চলছেই! নরমাল পানিতেই শরবত করে দিতে পারতে।”

শাওনের কণ্ঠস্বরে হালকা রাগের আভাস! তাতে মনঃক্ষুণ্ন হলো চারুর। গলার কণ্ঠ নীচু করে স্বামীকে জবাব দেয়,

“গরম পড়েছে, ক্লান্ত তুমি। সেজন্যেই দিলাম। আরাম লাগবে ভেবে।”

“তোমার এসব ভাবাভাবি বন্ধ করো। এরকম ভাবতে গিয়েই তো চুলগুলো কেটে ফেলেছো!”

কথা গুলো বলে আর এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় না করে শাওন চলে যায়। সে একই জায়গায় হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে চারু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কত যত্নসহকারে শরবত বানিয়ে এনেছিলো। শাওনের কাছে দাম পেলো না। যত্ন করে কিছু করলো ফলাফল বোধহয় এরকমই হয়? প্রশ্নের উত্তর পেলো না আর। নিজেই সেই শরবত টুকু ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে আরামে সোফায়  পায়ের উপর পা তুলে বসলো। গরমে ঠান্ডা শরবত যেনো প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। সর্বাঙ্গ শীতল হয়ে গিয়েছে। হাতে নিলো  ফোন। ফোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চারুর ঠোঁটে দেখা দিচ্ছে মৃদু হাসি। অথচ এই একটু আগেই স্বামীর ব্যবহারে কি মন খারাপই হচ্ছিলো তার। সব ভুলে ফোনে বেশ ভালোভাবেই মগ্ন হয়েছে চারু। একটু আগে সে নিজের সাথে কি করলো সেটাও বোধহয় মস্তিষ্ক থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে।

রাত্রি তখন তিনটের সময়। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে শাওন।  গরমে সারাদিন অফিসে পরিশ্রম করে এসে ক্লান্ত শরীর রাত্রি সাড়ে দশটার ঘরে পৌঁছাতেই চোখে নিদ্রারা এসে ভর করেছে বেশ ভালো ভাবেই। পাশেই নিদ্রাহীন ভাবে শুয়ে ছিলো চারু।  শোয়া থেকে আধশোয়া ভঙ্গিতে উঠে বসলো। চোখ দু’টো বড়বড় করে শাওনকে পর্যবেক্ষণ করলো বেশ সময় নিয়ে। নিদ্রায় আছে নিশ্চিত হতেই  বিছানা ছেড়ে আলগোছে নামলো। হাতে নিলো ফোন। পা টিপে টিপে বারান্দায় গেলো যাতে আওয়াজ শুনে শাওনের নিদ্রার কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। দোতলা বিশিষ্ট বাড়িখানার বারান্দায় দাঁড়াতেই সর্বাঙ্গ জুড়ে শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেলো। চারুও পরম আনন্দে দু হাত মেলে বাতাসকে জড়িয়ে  নিলো শরীরে। ঘরে চলা ফ্যানের ঠান্ডা বাতাসের চেয়ে প্রকৃতির ঠান্ডা বাতাসকে বড্ড ভাল্লাগে তার!  কয়েক মিনিট অতিবাহিত হবার পর চারু ফোনের দিকে তাকালো। প্রথমে সাইলেন্ট করে ফোনের লক খুলতেই ফোনের ওয়েলপেপারে  নিজের একটা ছবি দেখতে পেয়ে হাসলো বোধহয়। রহস্যময় সে হাঁসি।  তারপর মনোযোগী হলো নিজের কাজে। এভাবেই প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বারান্দায়ই থাকলো চারু। শাওন টেরও পেলো না তার সঙ্গিনী তার পাশেই নেই! বিবাহিত জীবনের তিন বছর হয়ে যাচ্ছে প্রায়, তাদের সংসারের রোজ রুটিন হচ্ছে সকালেই শাওন অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পরে আর চারু সংসারের টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত থাকা। শাওনের চাকরিসূত্রে চারু শাওনের সাথে শহরে এসে থাকে। শ্বশুর শাশুড়ি সবাই গ্রামেই আছে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে ছেলে বউয়ের কাছে এসে থেকে যান তারা। সারাদিনই চারুর একাকী সময় কাটে। অন্যদের মতন ফোন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায়ও সে আসক্ত নয়। ফলস্বরূপ নিজের সাথেই নিজেই দিন পার করে কেবল রাতটুকু ছাড়া। রাতটুকুই শাওনকে কাছে পায়।

সকালবেলা…….

“চারু? এই চারু?”

বেশ অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় ঘুমন্ত চারুকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে শাওন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। এদিকে শাওনেরও অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চারু উঠছে না। কিছু না বলেও শাওন বের হতে পারছে না। পড়েছে বেশ মুশকিলে। একসময় ডাকতে ডাকতে চারু চোখ খুলে তাকালো। আড়মোড়া ভেঙে শাওনের দিকে তাকায়,

“হ্যাঁ বলো।”

“কি হয়েছে তোমার?”

শাওনের কথায় চারু কিছুটা ভ্রূ কুঁচকে শাওনকে জিগ্যেস করে,

“আমার আবার কী হবে?”

“কিছু না হলে ঘুমাচ্ছো যে এখনো?”

“ওহ্ দেরি হয়ে গেলো উঠতে!”

চারুর কথা শুনে শাওন সন্দেহান দৃষ্টিতে চারুর দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। কি হয়েছে ? এরকম দেরি করে তো খুব কমই উঠে। উদগ্রীব কণ্ঠে জিগ্যেস করে,

“তোমার আবার শরীর খারাপ হয়নি তো?”

এই বলে শাওন উদ্বিগ্ন হয়ে কপালে হাত দিয়ে চেক করলো  জ্বর এসেছে কিনা। শরীরের তাপমাত্রা ঠান্ডা বুঝতেই শাওন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। চারুর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

“নাহ্, জ্বর আসেনি। সুস্থই আছো তুমি।”

শাওনের এরকম উৎকণ্ঠা দেখে চারুর বেশ ভালো লাগে।  দেয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে চোখ বোলাতেই দেখে শাওনের অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে। শাওন তো এক্ষুনি বেরিয়ে পড়বে! অথচ সে কিনা ঘুমাচ্ছিলো! বেশ তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছাড়তে ছাড়তে শাওনকে বলে,

“আমি চটজলদি করে তোমাকে খাবার বানিয়ে দিচ্ছি।”

“তা আর লাগবে না।”

“কেনো? খাবে না?”

“না, দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক। বাহিরে খেয়ে নিবো। এখন তোমার খাওয়ার আশায় বসে থাকলে আমার দেরি হবে যা চাইছি না!”

কথা শেষ করে শাওন ব্যস্ত পায়ে দ্রুত হাঁটা ধরলো। শাওনের যাবার পানে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকলো চারু।  শাওনের বলা কথায় মনে মনে বেশ কষ্ট পায় । অথচ এই কথাতে তার কষ্ট পাওয়ার মতন তেমন কিছুই হয়নি, সাধারণ কথাই তো! তবুও চারুর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যেনো চোখ বেয়ে এখুনি অশ্রুর ঝর্ণাধারা বইবে। এতো কষ্ট হয়তো স্বামীকে অভুক্ত রেখে পাঠাচ্ছে সেজন্য? নাকি অন্য কোনো কিছু?

পর্ব-২ । শেষ পথে – মীরাতুল নিহা

বিছানা ছেড়ে উঠে চুলগুলো হাত খোঁপা করে রান্না ঘরে গিয়ে নাস্তা বানানো রোজকার একটি অভ্যাসের মধ্যে পড়ে চারুর। সে মোতাবেকই হাত দু’টো চুলে দেয় খোঁপা করার জন্য। ছোটো চুলগুলো দিয়ে যখন মনের বেখেয়ালে খোঁপা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলো  তখনই মনে পড়ে গেলো তার তো সেই কোমর সমান লম্বা চুল গুলিই নেই! তবুও মন খারাপ না করে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হবার জন্য। নয়টা বেজে গেছে। এরই মধ্যে কলিং বেল এর আওয়াজ শুনতে পায়। শাওন তো অফিসে চলে গেছে, সারাদিন সে একাই সময় পার করে তবে কে এলো এই সময়? মনে খুঁতখুঁতানি নিয়ে  দরজা খুলতেই বাহিরে নিজের একমাত্র ননদ ইরিনকে দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা দেয় চারুর। ইরিনও জড়িয়ে ধরে তার ভাবিকে। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,

“কতদিন পর

ইরিনের কথা সেখানেই স্তব্ধ হলো! চারুকে দেখে দু চোখ বড় বড় করে বললো,

“ভাবী তোমার চুল!”

“ভেতরে এসে বসো আগে তারপর বলছি।”

চারুর কথানুযায়ী ইরিন ভেতরে গিয়ে বসে। সোফায় বসতেই  চারু ইরিনকে বলে,

“সকাল সকাল এসেছো নাস্তা করবে না?”

“আরে ভাবী রাখো তোমার খাওয়া! খেয়েই এসেছি আমি। আগে বলো চুলের এই দশা কেনো?”

“কেটে ফেলেছি। লম্বা চুল পছন্দ না বলে।”

ইরিন কিছুটা বিস্ময় নিয়েই উত্তর দেয়,

“কার পছন্দ নয়? তোমার? নাকি ভাইয়ার?”

“তোমার ভাইয়ার ইদানীং পছন্দের রং বদলেছে বুঝলে?”

কথাখানা বলেই চারু হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে প্রায়। ইরিন অবিশ্বাস্য চোখে তার ভাবিকে দেখছে। চারুর লম্বা চুলগুলো যে কত যত্ন করতো সেটা ইরিন বেশ ভালো করেই জানে। সে শখের চুলগুলো শেষ? এক পর্যায়ে নিজেই হাসি বন্ধ ইরিনকে জিগ্যেস করে,

“ পুরো ছয় মাস পর! তা এতোদিনে মনে পড়লো?”

“মনে তো সবসময়ই থাকে ভাবী। কিন্তু পড়াশোনার চাপে আসা হয় না।”

“এই পড়াশোনার চাপেই না তুমি চ্যাপ্টা হয়ে যাও কোনোদিন!”

“মন্দ বলো নি ভাবী। হয়ে যেতেও পারি। ঠিক নেই।”

এভাবেই দুই ননদ ভাবী মিলে গল্প করতে থাকে সোফায় বসে বসে।  চারুর বিষণ্নতা দিয়ে শুরু করা সকাল ইরিনের আগমনে যেনো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। একজনকে পেয়ে  আর হুঁশই রইলো না সে কি করবে না করবে! চারু আর ইরিন সম্পর্কে ননদ ভাবী হলেও ইরিনের সাথে চারুর বয়সের ফারাক মাত্র এক বছরের। সেজন্যই তাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতন। গল্প করতে করতে এমন অবস্থা যে সময়ের দিকেও খেয়াল রইলো না আর। খেয়াল হলো যখন কানে আজানের শব্দ আসলো,

“এই যাহ্। জোহরের আজান দিয়ে দিলো তো। আমি গল্প করতে করতে রান্নার কথাই ভুলে গেছি।”

“তোমার দেওয়া চা বিস্কিট খেয়ে আমারও তেমন খিদের কথা মনেই ছিলো না এতক্ষণ। তবে ভাবী এবার জোর কদমে খিধে পেয়েছে।”

ইরিনের কথায় চারু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। যা গরম পড়েছে দুপুর বেলা এখন রান্না করাটা বেশ ঝামেলার। তার উপর খেতে খেতেও দেরি হবে। নিজে একবেলা অভুক্ত থাকলেও সমস্যা হতো না কিন্তু মেহমানকে কি করে রাখবে?

“তুমি ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে আসো। ততক্ষণে খাবার হয়ে যাবে। দেখি অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি।”

ইরিনকে কথা টা বলে চারু নিজেও যায় গোসলের উদ্দেশ্য। যাবার আগে মুঠোফোনের সাহায্য অনলাইন থেকে খাবার অর্ডার দিতে ভুলে না৷ প্রায় চল্লিশ মিনিট পর চারু নামাজ পড়ে বের হয় রুম থেকে। ড্রয়িং রুমে এসে দেখে ইরিন বসে আছে। হয়তো খুব খিধে পেয়েছে!

“ইরিন একটু অপেক্ষা করো খাবার চলে আসলো বলে।”

চারু ইরিনকে কথাটা বলতে না বলতে ওমনিই কলিং বেল এর আওয়াজ শুনতে পায়।

“ওই দেখো চলে এসেছে বোধহয়।”

চারু দরজা খুলতে যায়। আশা করেছিলো হয়তো ডেলিভারিম্যান এসেছে। কিন্তু দরজা খুলে শাওনকে দেখতে পাবে এই ভর দুপুরবেলায় তাও একটি মেয়ের সঙ্গে ব্যাপারটা মোটেও চারু আশা করেনি! মেয়েটাকে যে সে চেনে না এমনও না। খুব ভালো করেই চিনে। মেয়েটার নাম নিশি। অফিসে একসাথে কাজ করে। শাওনের সাথে বেশ অনেকবারই মেয়েটাকে দেখেছে চারু। তবে শাওন যে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসবে এটা আশা করেনি। মেয়েটার পড়নের জামা কাপড়ও ভাল্লাগলো না। কারণ নিশির পড়নে ছিলো ওয়ের্স্টান ড্রেস আর গায়ে পাতলা স্কার্ফ। প্রশ্ন করলো শাওনকে,

“কি হয়েছে?”

“দেখেছো সাথে একজন আছে। তবুও দরজার বাহিরে রেখে প্রশ্ন করছো কেনো চারু? ভেতরে আসবো না?”

শাওনের কথায় চারু কিছুটা আমতা আমতা করে বলে,

“হ্যাঁ হ্যাঁ ভেতরে এসো।”

দুজনে মিলে ভেতরে এসে সোফায় বসে। ইরিনকে দেখে শাওন জিগ্যেস করে,

“আরে কখন এলি?”

“এসেছি ঘণ্টা খানেক আগে ভাইয়া। ছুটি পেয়েছি তাই ভাবলাম কদিন থেকে যাই।”

“একদম ভালো করেছিস!”

বোনের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে শাওন চারুকে বলে,

“অফিসে আজকে দ্রুতই ছুটি দিয়ে দিয়েছে কাজ সেরে ফেলায়। আসার সময় গাড়ি পাচ্ছিলাম না, নিশির গাড়িতে করে আসছিলাম পথের মধ্যেই শরীর খারাপ হয়। ওরকম অবস্থায় ওকে একা ছেড়ে দিতে পারলাম না। তাই বাসায় নিয়ে এসেছি। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করো তো।”

চারু শাওনের কথা শুনেও যেনো শুনলো না এমন ভাব। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে নিশির দিকে। মেয়েটা শুধু ভেতরে ঢোকার সময় মুচকি হাসি দিয়ে চারুর দিকে একবার তাকিয়েছিলো। আর কোনো সাড়া শব্দ নেই। সোফায় শাওনের পাশেই বসে আছে। শাওন চারুকে যা বলার বলে বোনের সাথে কিছুক্ষণ গল্পে মগ্ন হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারু অর্ডারকৃত খাবার গুলো ভেতরে আনে। রান্না ঘরে গিয়ে প্লেটে করে তিন প্লেট বিরিয়ানি আর নুডুলস সাথে কোক নিয়ে আসে। এক প্যাকেট বিরিয়ানি চারু ইচ্ছে করেই অর্ডার দিয়েছিলো শাওনের জন্য। শাওনকে ছাড়া তার মুখে যেনো কোনো ভালো খাবার উঠেই না! আপাতত মনে হচ্ছে ভাগ্যিস এক প্লেট বেশি অর্ডার করেছিলো। খাবার গুলো ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে দিতেই সবাই খাওয়া শুরু করে। চারু এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগে কারো কিছু লাগবে কি-না। শাওনের পাশের টেবিলেই নিশি বসেছে যেখানে চারু বসতো। চারু সবার খাওয়াই পর্যবেক্ষণ করছে। শাওনের খাওয়া শেষ হতেই চারুকে বলে,

“নিশির একটু রেস্ট দরকার। ওকে ভেতরের রুমটা দেখিয়ে দিও তো চারু।”

“আচ্ছা দিচ্ছি।”

এই বলে চারু নিশির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

“চলুন আপনাকে রুমে নিয়ে যাই। রেস্ট নিলে আশা করি শরীর ঠিক লাগবে?”

নিশি চারুর দিকে হালকা হেঁসে তাকিয়ে উত্তর দেয়,

“শাওন আমাকে নিয়ে বেশিই ভাবছে ভাবী। আপনি মাইন্ড করিয়েন না কেমন?”

“মাইন্ড করবো কেনো আপু? আমার স্বামী বেশ পরোপকারী। নিজের চেয়ে লোকের চিন্তা বেশি করে।”

কথাটা বলে যেনো নিজেকে বিজয়ী প্রমাণ করেছে চারু এরকম ভাব এসেছে সর্বাঙ্গে। দু’জনকে কথা বলতে দেখে মাঝখানে ফোঁড়ন কাটে শাওন,

“গল্প পরে করিও। ওকে রেস্ট করতে দাও।”

আর দেরি না করে চারু নিশিকে রুম দেখিয়ে দেয়। ইরিন আস্তে আস্তে খাওয়ায় সবে খাবার শেষ হলো।

“ভাবী? তুমি খেলে না?”

“আমি পরে খাবো ইরিন। আমাকে নিয়ে ভেবো না তো।”

ইরিনকে বুঝ দিয়ে চারু রান্না ঘরের দিকে যায়। কি খাবে রান্নাই তো হয়নি! এক্সর্টা বিরিয়ানি নিশিই খেয়ে ফেলেছে। এদিকে পেটে জোর ক্ষিদেও পেয়েছে দুপুর হওয়ায়। না পারতে চারু ফ্রিজ খুলে একটা ডিম বের করে নেয়। সাথে নেয় পাউরুটি। শাওন না হয় চারুর কথা ভাবলো না কিন্তু তার তো নিজের কথা ভাবতে হবে! কোনোমতে পাউরুটি ডিম ভেজে খেয়ে নিলো। একটু পরই রাতের রান্না করতে হবে। তবে সবাই যেহেতু ভারী খাবার খেয়েছে সেক্ষেত্রে বিকেলের নাস্তা আগে তৈরি করে তারপর রাতের রান্না করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো চারু। আজকে নিশি এসেছে বাড়িতে সাথে ইরিনও। দুজনেই বাড়ির অতিথি। ইচ্ছে হলো নতুন আইটেম বানালে শাওন নিশ্চয়ই খুশি হবে? অত নাস্তার আইটেম পারেও না সে। ইউটিউব ঘেঁটে রান্না করতেও ঝামেলা লাগে। তখনি মাথায় এলো ইরিন খুব ভালো নাস্তার আইটেম বানাতে পারে। সিদ্ধান্ত নিলো ইরিনকে জিগ্যেস করে নতুন রান্না করবে। সে অনুযায়ী চারু গিয়ে হাজির হয় ইরিনের রুমে।

“আছো ইরিন?”

ইরিন তখন বিছানায় হেলান দিয়ে বই পড়ছিলো। চারুকে দেখে উঠে বসে

“হ্যাঁ ভাবী বলো? তোমার কথাই ভাবছিলাম।”

“আমার কথা কী ভাবছিলে আবার?”

“উমমম তুমি না আসলে তোমাদের। এই ভাবী তুমি কি ভুলে গেছো ক’দিন পরই ভাইয়ার জন্মদিন? কি করবে? মানে ভাইয়াকে কি চমক দিবে সেদিন? কিছু ভেবেছো নাকি বলো?”

ভাগ্যিস ইরিন বললো জন্মদিনের কথা! নয়তো চারু বেমালুম ভুলেই যেতো।

“এবার তোমাকে ভাইয়াকে সবচেয়ে বড় চমক দিবো দেখো।”

“দেখার অপেক্ষায় রইলাম ভাবী।”

চারুর যা দরকার ছিলো ইরিনের সাথে তা মিটিয়ে নিজের কাজের জন্য রান্না ঘরে যায়।

পর্ব-৩ । শেষ পথে – মীরাতুল নিহা

নিজের কাজ করতে করতে ঘড়ির কাঁটায় তখন সারে চারটে বাজে। ইরিন জার্নি করে আসার কারণে ঘুমাচ্ছে। শাওনকে রুমেই দেখেছিলো কাজ করার সময় চারু। নিশিকে দেখার উদ্দেশ্য রুমে গিয়ে উঁকি দেয়। দরজা পুরোপুরি লাগানো ছিলো না বিধাঁয় চারুর দেখতে বেগ পেতে হয়নি। গিয়ে দেখতে পায় সে রুমে নিশির সাথে শাওনও রয়েছে। শাওন তো রুমে ছিলো তবে নিশির রুমে কখন এলো? স্থির নয়নে সে কেবল শাওনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। দুজন মিলে হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। চারু হালকা কাশি দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,

“আসবো?”

“আরে চারু পারমিশন নিচ্ছো কেনো? এসো।”

শাওনের কথা শুনে চারু ভেতরে যায়। ভেতরে যেতেই দেখে নিশি আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে আছে। সামনে শাওন বসা। ভেতরে গিয়ে সে শাওনের পাশে বসে নিশিকে শুধায়,

“এখন শরীর ঠিক লাগছে তো?”

নিশি উত্তর দেবার আগেই শাওন নিজ থেকে বলতে আরম্ভ করে,

“হ্যাঁ ভালোই আছে বললো। একটু পরই চলে যাবে।”

“সে-কি নাস্তা না করে চলে যাবে?”

“না ভাবী আপনাকে কষ্ট দিয়ে আর লাভ নেই। শাওনের সাথে যখন একই অফিসে কাজ করি তখন হয়তো আবারো দেখাসাক্ষাৎ আমাদের হতে পারে।”

চারু ভদ্রতার সহিত মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ নামক সম্মতি বোঝাতেই নিশি ফের বলে,

“শাওনের কাছে আপনাদের সংসারের বিষয়ে টুকটাক গল্পও শুনেছি। আপনি চুল গুলো কেটেছেন, ভালো পার্লারে গিয়ে কাটতেন। দেখতে সুন্দর লাগতো। এভাবে তো কোনো স্টাইলই হলো না!”

নিশির এরূপ কথা চারু অপমানিত বোধ করলেও মুখে মিষ্টি হাসি বজায় রেখে বলে,

“আমি যেভাবেই করি না কেনো সেভাবেই আমাকে সুন্দর লাগে। এ কথা আমি নয় আমার স্বামী বলে জানেন তো?”

চারুর মুখে হাসি। যেনো মোক্ষম জবাব দিয়েছে নিশির কথার উত্তরে। নিশিও যেনো ছাড়বার পাত্রী নয়। মুখ খুললো,

“কিন্তু শাওনের পছন্দ যতটুকু বুঝেছি হয়তো আরেকটু অন্যরকম!”

“মানুষের পছন্দ ও বদলায়। তা নিশ্চয়ই জানেন?”

“বেশ বেশ। তবে টিপস লাগলে আমাকে বলতে পারেন। আমি নামিদামি ভালো পার্লারে যাই তো।”

“তারও বোধহয় দরকার হবে না৷ তবে দরকার পড়লে আমি নিশ্চয়ই শাওনকে দিয়ে বলবো।”

“আপনার হাতের রান্না কিন্তু বেশ! আবার আসলে কিছু বলবেন না তো?”

নিশির কথা শুনে চারুর হাসি পেলেও পেলো না। মেয়েটা জানেই না রান্না চারু নিজ হাতে করেনি খাবার অর্ডার করেছে অনলাইন থেকে।

“ইচ্ছে হলে আসতে পারেন।”

নিশি আর প্রতি উত্তরে তেমন কিছু বলে না। চারুর কথা বলার ধরন যে তার ভাল্লাগে নি চেহারা দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেজন্যই হয়ত যাওয়ার তাড়া! আর দেরি না করে শাওনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। নিশি চলে যেতেই চারু ভেতর থেকে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো!

“চারু? তোমার কি নিশিকে পছন্দ হলো না?”

শাওনের প্রশ্নে চারু ভ্রূ কুঁচকে শাওনের দিকে তাকায়।

“কেনো?”

“না মানে কেমন করে কথা বললে বলে মনে হলো!”

“আমি তো উত্তর দিয়েছি কেবল।”

“তবে সত্যি, ছোটো চুলে তোমাকে ভাল্লাগছে না। লম্বা চুলই তোমার জন্য ঠিক ছিলো।”

“কই যখন লম্বা চুল ছিলো অতো প্রশংসাও তো করোনি কখনো।”

“প্রশংসা সবসময়ই করতে হবে তারও মানে নেই। তবে এভাবে তোমাকে ভাল্লাগছে না। নিশি ভুল কিছুও বলেনি।”

শাওনের কথায় চারু মৃদু হেঁসে রুম থেকে চলে যায়। নিজের মনে মনে বলতে থাকে –ঠিক কীভাবে কি করলে পুরুষ মানুষের মন ভরে?

রান্না ঘরে গিয়ে চুপচাপ রান্না করতে লাগে চারু। টেবিলে সে নাস্তা পরিবেশনও করে এসেছে। নিজে খায়নি। খেতে ইচ্ছেই করেনি একপ্রকার। মনটা কেমন ভার হয়ে আছে। চুলার আঁচ একটু কমিয়ে চারু ফোনটা হাতে নিলো। কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আবারো কাজে মশগুল হয়ে পড়ে। এরই ভেতর রান্না ঘরে এসে উপস্থিত হয় শাওন। এসেই আচমকা হুট করে চারুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। শাওনের কান্ডে চারুও অবাক হয়ে পড়ে। সে আগের ন্যায়ই দাঁড়িয়ে থাকে স্বামীকে কোনোরূপ বাঁধা প্রদান না করে। শাওন চারু একদম কাছ গিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে ভারী কণ্ঠে শুধায়,

“সারাক্ষণ কেবল কাজই করো?”

“কাজ থাকলে তো করতে হবে। যেমন তুমি বলো।”

চারুর উত্তর শুনে শাওন চারুকে তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে জিগ্যেস করে,

“আমাকে সময় দেওয়া তোমার কাজের মধ্যে কবে পড়বে?”

“যখন তুমি তোমার পুরোপুরি সময়টা আমাকে দিতে পারবে।”

চারুর কথা শুনে শাওন চারুকে পুরোপুরি ভাবে ছেড়ে দেয়। দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।  চেহারায় ফুটে উঠে অন্য এক শাওনের আভাস। যেন প্রচণ্ড রেগে আছে!

“কাজ তো আমি তোমার জন্যই করি। এই সংসারের জন্য।”

“আমিও তো তোমার সংসারের জন্যই করছি!”

“সবসময় এক কথা! ধুরো!”

এই বলে শাওন রাগ দেখিয়ে রান্না ঘর থেকে চলে যায়। শাওন যেতেই চারু কেমন পলকহীন ভাবে শাওনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আনমনেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো গালে। শাওনের একটু কথায় চারুর বুকে ভীষণ কষ্ট জমে। এই ব্যাপারগুলো শাওন কবে বুঝবে? পুরোটা দিন যখন একা একা থাকে শাওনের অভাব বেশ ভালো করেই পীড়া দেয় চারুকে। স্বামীকে ছেড়ে এক সেকেন্ড ও মেয়েটা থাকতে পারে না সেখানে গোটা দিন পার করে। সময়ের খাতিরে এখন সেটা অভ্যাস তো হয়ে গেছে কিন্তু এখনো চারুর বুকে প্রথম দিনের মতনই কষ্ট অনুভব হয়। ধ্যান ভাঙে চুলায় বসিয়ে রাখা পাতিলের পানি ফুটে চুলার আশেপাশে পড়তেই। আবারো কাজে মনোযোগী হয়ে পড়ে।

সন্ধ্যাবেলা দুই ভাই বোন মিলে গল্পের আসর জমিয়েছে। সেখানে ভাগ বসাতে গিয়ে বসে পড়ে চারু। ভাবিকে দেখতে পেয়েই ইরিন উৎফুল্ল কণ্ঠে শুধায়,

“ভাইয়া? চল না শপিংয়ে যাই! সবাই মিলে?”

“আচ্ছা।”

একমাত্র বোনের আবদার হয়তো ফেলতে পারলো না শাওন। সেজন্য ইরিন, চারু, শাওন তিনজনে মিলে বেরিয়ে পড়ে শপিংয়ের উদ্দেশ্য। একটা বড় দোকানের সামনে এসে তিনজন থামে। দোকানের ভেতরে গিয়ে ঢুকে জামাকাপড় দেখতে থাকে। শাওন ওদের পিছন পিছনই আছে। হুট করে চারুর চোখ গিয়ে পড়ে একটা নীল রঙের শাড়ির দিকে। নীল রং তার বড্ড পছন্দ তার উপর শাড়িটাও কি সুন্দর! দেখেই যেনো চোখ আটকে যায়। চারু আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। শাওনকে ধরে শুধায়,

“দেখো দেখো নীল শাড়ি টা কি সুন্দর না?”

“হ্যাঁ সুন্দর।”

“এটা নিবো তাহলে বলছো? নাকি অন্য কোনোটা?”

“নিয়ে নাও যেটা পছন্দ হয়েছে।”

চারু খেয়াল করলো শাওনকে যতোটা আনন্দ নিয়ে সে কথাটা বললো শাওন তাকে দু পয়সার পাত্তাও দিলো না। শাওন তো ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে, মাথা তুলে এক পলক তাকিয়ে দেখলোও না তার স্ত্রী কোন শাড়ির কথা বলেছে! চারুর মনে শাওনের জন্য সুপ্ত অভিমান জমা হলো। বাড়ি হলে এক্ষুনি চোখ বেয়ে গড়গড়িয়ে জল বেরিয়ে আসতো। বাহিরে আছে বলে নিজেকে সামলে নিয়ে ইরিনের কাছে গেলো। পছন্দ করা শাড়িটা নেওয়ার আর কোনো ইচ্ছেই রইলো না!

“কিছু পছন্দ হলো ইরিন?”

ইরিনকে বলতেই ইরিন হাতে রাখা একই রকম দেখতে দু’টো শাড়ি চারুকে দেখিয়ে বললো,

“দেখো তো পছন্দ হয় কি-না?”

“দেখতে ভালো তো।”

চারুর কথায় প্রাণোচ্ছল ভাবে হাসে ইরিন।

“আমি জানতাম তোমার পছন্দ হবে। সেজন্যই তো একরকম দেখতে দু’টো শাড়ি নিয়েছি।”

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে!”

“কিন্তু ভাবী? পরশু তো ভাইয়ার জন্মদিন। তুমি আমার দেওয়া শাড়ি পড়বে?”

চারু কোনো ভাবনা ছাড়াই উত্তর দিলো,

“হ্যাঁ কেনো নয়?”

“বোকা ভাবী! ওইদিন তুমি ভাইয়ার সাথে মিলিয়ে এক রঙের শাড়ি পড়বে বুঝেছো? লাগলে এখান থেকে আজকে কিনে নিতে পারো দুজনে ম্যাচিং করে।”

ইরিনের কথায় চারু কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো। ইরিন কত ভাবে তাকে নিয়ে৷ অথচ শাওনের একটু সময়ও হয় না চারুর দিকে তাকাবার! পুরো সময় টুকু মন খারাপ করেই চারু ইরিনের সাথে কেনাকাটা করে বাড়িতে ফিরলো। শাওনের মন একবার ফোনের স্ক্রিনে তো আরেকবার বাহিরের দিকেই ছিলো। ব্যাপারটা বেশ ভালো ভাবেই চারু লক্ষ্য করলো।

পর্ব-৪ । শেষ পথে – মীরাতুল নিহা

অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে সকাল থেকে বেশ ব্যস্ত চারু! একটু পরই শাওনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সব বন্ধুরা চলে আসবে। তার আগেই সমস্ত কাজ কর্ম শেষ করতে হবে। দ্রুত কাজ সারতে সাথে হাত লাগিয়েছে ইরিনও। আর দু একটা পদ রান্না করলেই একদম শেষ।

“ইরিন? পাস্তাটা হলো তো?”

ইরিন পাস্তার কড়াইতে খুন্তি খুন্তি নাড়তে নাড়তে চারুকে জবাব দেয়,

“আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হয়ে যাবে।”

“বেশ। তাহলে তুমি মাংসটা একটু দেখো। আমি আসছি।”

ইরিনকে দেখতে বলে চারু শাওনের কাছে যায়। শাওন তখন ফোনে ব্যস্ত ছিলো। চারু রুমে যেতেই শাওনের দৃষ্টি পড়ে চারুর দিকে। কোমড়ে কাপড়ের আঁচল গুঁজে একদম গিন্নির মতন সকাল থেকে কাজ করছে মেয়েটা! চারু বসতেই শাওন এগিয়ে এসে রুমাল দিয়ে চারুর ঘামে ভেজা মুখটা মুছিয়ে দিলো পরম যত্নসহকারে। চারুর মুখে তখন মিষ্টি হাসি স্বামীর যত্ন পেয়ে।

“ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছো দেখছি!”

“ও কিছু না। তুমি গোসল সেরে নাও।”

“যাবো, কিছু দরকারে এসেছো?”

“না এমনিই।”

শাওনকে তাড়া দিয়ে চারু আবারো রান্নাঘরে যায়। শাওন আবারো ফোনে ব্যস্ত হয়ে থাকে। গরমের ভেতর প্রায় তিন ঘণ্টা যাবত আগুনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অসহ্য লাগছে এবার। ইরিনের রান্না শেষ। চারুরও প্রায় শেষের পথে। এদিকে গরমে জান যায় যায় অবস্থা। রুমে গিয়ে যে ফ্যানের নিচে বসবে তারও জো নেই। রান্না পুড়ে যাবে! তখনই চারু চোখের সামনে শরবতের গ্লাস ধরা দেখতে পায়! যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

“নেও ভাবী শরবত টুকু খেয়ে নাও।”

চারু কোনো কথা না বলে পুরো এক টানে শরবত টুকু খেয়ে নিয়ে ইরিনের দিকে কৃতজ্ঞতা মূলক হাসি দিলো,

“বাঁচালে আমায়!”

“আমি হেল্প করে দিবো ভাবী?”

“নাহ্ লাগবে না। প্রায় দুপুর হয়ে যাচ্ছে শাওনের বন্ধু বান্ধবরা সব চলে আসবে। তাদের খেতে দিতে হবে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”

“আর তুমি?”

“কাজ শেষ করে আসবো।”

ইরিন চলে যায়। চারু চুলা থেকে মাংসটা নামিয়ে দুধ বসিয়ে দেয় পায়েস বানানোর উদ্দেশ্য। প্রতি বছরই শাওনের জন্মদিনে চারু বেশ যত্ন করে পায়েস রাঁধে। এ বছরও তার অন্যথা হলো না। মনোযোগ সহকারে পায়েস বানানো শেষ করে চারুও চলে যায়।

সকাল থেকে শাওনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বেশ ফুরফুরে মেজাজে সব কাজ করছিলো চারু। এখন সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। তবে মুখে সেই মিষ্টি হাসিখানা গায়েব। কারণ হিসাবে শাওনের বন্ধুদের সাথে অফিস কলিগ নিশিকে দায়ী করা বোধহয় ভুল হবে না। এই মেয়েটাকে চারুর মোটেও ভাল্লাগে না। কেমন গায়ে পড়া স্বভাবের! তারউপর খেতেও বসেছে শাওনের পাশের চেয়ারে। শুধু নিশি নয় শাওনের আরেকটা কলেজ ফ্রেন্ডও নাকি এসেছে নাম টিয়া। টিয়াপাখির মতনই বকবক করে যাচ্ছে খেতে বসেও। আর এসেছে শাওনের কয়েকজন ছেলে বন্ধু। ছেলেদের নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি নেই চারুর তবে মেয়ে দু’টোকে একদমই ভাল্লাগছে না। বিশেষ করে নিশিকে! তবুও ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছে না।

“কি ভাবি? সেদিন যাওয়ার ক’দিন  দিন পরই আবার চলে আসলাম। কিছু মনে করলেন না তো?”

“নাহ্ মনে তো করিনি।”

“কিন্তু ভাবী আজকে আপনার হাতের রান্না সেদিনের মতন অতো স্বাদ হলো না কেনো!”

নিশির প্রশ্নে চারু উত্তর দেওয়ার আগে শাওনের বন্ধু আমান প্রতিত্তোর করে,

“রান্না তো দিব্যিই হয়েছে নিশি।”

“আরে আমান সেদিন ভাবী আরো ভালো করে রান্না করেছিলো।”

“যাই বলো আমার তো আজকের রান্না বেশ ভালোই লাগছে। দেখছো না এক প্লেট শেষ করে আরেক প্লেট নিয়ে বসেছি।”

দুজনের কথোপকথনের মাঝখানে শাওন বেশ খোঁচা মেরেই তার বন্ধু আমানকে বলে,

“তুই যে পেটুক সেটা সবাই জানি। আর বলতে হবে না।”

আমান হাতে শষার টুকরো নিয়ে কামড়ে খেতে খেতে বলে,

“কিছু থাকলে তো বলবি ভাই?”

“টিয়াকে বলবো মুখটা খুলতে?”

“দোহাই লাগে বলিস না প্লিজ! টিয়ার মুখ খুললে আর সহসা বন্ধ হয় না।”

আমানের কথায় বেশ উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে সবাই। টিয়া মুখটা গম্ভীর করে উত্তর দেয়,

“যেমন তুইও খাওয়ার জন্য মুখ খুললে সহসা বন্ধ হয় না!”

“একদম বাজে বকবি না টিয়া। তুই জানিস না? খাওয়াই জীবন। মানুষ বেঁচে আছেই তো খাওয়ার জন্য!”

টিয়া ভ্রূ জোড়া কুঁচকে শাওনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তুমি ওর মুখ বন্ধ করে পেট ভরতে বলো শাওন!”

“ভাই তোরা খাওয়া শেষ কর। ভুলে গেলি? খাওয়ার পর সবাই বসে আড্ডা দিবো।”

শাওনের কথায় সবাই খাওয়ার স্পিড বাড়িয়ে দেয়। চারু গোমড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো সবটা। আগের বছর ও আমান সহ বেশ ক’জন এসেছিলো তখন তার একটুও মন্দ লাগেনি। বরং বন্ধুদের খুনশুটি বেশ পছন্দই হয়েছিলো। তবে এই বছর নিশি আর টিয়াই চারুর আঁধার মুখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বামীর পাশে কোনো মেয়েকেই বোধহয় সহ্য করতে পারে না বাঙালি নারী। সে যতই বন্ধু হউক। একে একে খাওয়া শেষে শাওন সবাইকে নিয়ে আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ে। চারু ডাইনিং টেবিল গুছাতে থাকে। ওদিকে আর যায় না। রুমে যাবার উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। দরজায় আসতেই পা জোড়া থমকে দাঁড়ায়। ভ্রূ জোড়া উঁচু করে চোখ দুটো বড় করে তাকায়। আর ভেতরে ঢুকলো না সে। পিছিয়ে গেলো।  টলমল পায়ে ইরিনের রুমে গিয়ে বসলো। ইরিন তখন বই পড়ছিলো।

“ভাবী এসেছো?

চারু তখনও থম মেরে বসে আছে। ইরিনের বলা কথা যেনো তার কানে ঢুকেনি।

“ভাবী?”

ইরিন এবার বেশ জোরে  ডাক দেওয়ায় চারুর খেয়াল হলো। ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো।

“হ্যাঁ হ্যাঁ বলো?”

“এমনিই ডাকলাম। দুপুরবেলা এসেছো শুয়ে রেস্ট নাও খানিকক্ষণ।”

চারু মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দেয়,

“না ইরিন। শোবো না এখন। শাওনের বন্ধুরা গেলে তারপর।”

“আচ্ছা, তবে তুমি থাকো এখানেই।”

ইরিনও আর চারুকে না ঘাঁটিয়ে নিজে মনোযোগ হয় বই পড়ায়। ইরিনের রুমে চারু বসলো আরো বেশ অনেকক্ষণ। তারপর কিছু একটা মনে পড়ায় শাওনের বন্ধুরা যেখানে ছিলো সেখানে যায়। সেখানে যেতেই দেখে ড্রয়িং রুম পুরো ফাঁকা! শুধু শাওন আর টিয়া দাঁড়িয়ে আছে। দূরত্ব তেমনও নেই বললেই চলে।

“একি বাকিরা কই শাওন?”

“সবে চলে গেলো! তোমাকে তো খাওয়ার পরপরই আমান সহ দুজন বললো। এইতো টিয়াও যাচ্ছিলো এক্ষুনি।”

“ওহ্।”

চারু আর কিছু না বলে নিজের মতন দাঁড়িয়ে থাকে।

“আসলাম তবে?”

টিয়ার কথায় চারু হাসলো।

“আচ্ছা।”

শাওন তড়িঘড়ি করে বলে,

“আচ্ছা টিয়া তুই বের হো। আমিও বের হবো, কাজ আছে একটু।”

“তাহলে একসাথেই যাই বরং দুজনে।”

এই বলে প্রথমে টিয়া বের হয়ে যায়। তারপর শাওনও বের হয়। ধপাস করে দরজাটা বন্ধ করে চারু এবার তার নিজের রুমে গিয়ে বসে। বিছানার চাদরটা উঠিয়ে আলমারি খুলে নতুন চাদর বিছিয়ে দেয়। পুরোনো চাদরটা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খাটে নতুন পাতা চাদরে গা এলিয়ে দেয় আরামে। মাথার উপর ফ্যানটা ভোঁ-ভোঁ শব্দ করে ঘুরছে। চারু অপলক দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে চেয়ে শুয়ে আছে আর ভাবছে তার আপনমনে সবকিছু।

সন্ধ্যাবেলা…..

দুপুরে রান্না করা তরকারি গরম করার জন্য রান্না ঘরে আসে চারু। এসে দেখে সব তরকারি গরম করে রাখা আছে। ইরিন বাদে এই কাজ আর কারো নয়। মেয়েটা বড্ড ভালো। হুট করেই নজর যায় ঢাকা দেওয়া একটা বাটির দিকে। এই বাটিটাতে চারু যত্ন করে পায়েস তুলে রেখেছিলো শাওনের জন্য। ব্যস্ততায় বেমালুম ভুলে গেছে। সে এখনো ঘরে ফেরেনি ফিরলে না হয় দিবে। আজকের রাতটা যে বড্ড স্পেশাল শাওনের জন্য।

পর্ব-৫ । শেষ পথে – মীরাতুল নিহা

“রাত্রি এগারোটা বাজে চারু। কি সারপ্রাইজ দিবে? আর কতক্ষণ!”

 শাওনকে ছাঁদের উপর নিয়ে এসেছে চারু সারপ্রাইজ দিবে বলে। এদিকে শাওনের বড্ড ঘুম পেয়েছে! আবার কালকে অফিসও আছে। আজকে ছুটি নেওয়ায় কালকে দ্রুত যেতে হবে। সব মিলিয়ে শাওনের হালকা রাগ হলো চারুর উপর।

“এইতো! এতো অধৈর্য হলে হয় নাকি?”

“আচ্ছা।”

“শোনো না? বড্ড ভালোবাসি তোমায় শাওন!”

স্ত্রীর মুখ থেকে ভালোবাসি শুনে শাওন মুচকি হাসে। কিছু বলার আগেই চারু বলে,

“বিয়ের পর থেকে কেবল টাকার পিছনে ছুটেছো! আমার জন্য না কখনো তোমার সময় হয়েছে না কখনো নজর দিয়েছো আমার প্রতি। কতগুলো দিন হয়ে গেছে! তোমার দৃষ্টি কি আমার জন্য আটকায় না?”

কথাগুলোতে অভিমান স্পষ্ট। শাওন সেটা বুঝলো কি-না কে জানে!

“শোনো? সবকিছু ভবিষ্যতের কথা ভেবে করছি। আরাম আয়েশে ভালো থাকার জন্য। কাজ না করলে টাকা আসবে না। না তোমাকে ভালো রাখতে পারব না বাড়িতে বাবা মা ভালো থাকবে!”

চারু শাওনের কথায় প্রতি উত্তর করে না। যেনো জানে এমনটাই হবে। শাওন এটাই উত্তর দিবে। তার যে অভিমান হয় সেটা হয়তো তার স্বামী বুঝেও না! বুঝলে নিশ্চয়ই কথার ধরন এরকম হতো না। এরকমই হয়ে আসছে এতোগুলো দিন ধরে। স্ত্রী হিসেবে সবটাই সময়ের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলো এতোদিন। চারুকে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে সেটা সাদা শাড়ি পড়ার জন্য নয়। কেমন যেনো মুখে রহস্য লেগে আছে। পাশেই একটা টেবিলে রাখা শাওনের জন্য রান্না করা সেই পায়েসের বাটিটা থেকে এক চামচ পায়েস শাওনের মুখের সামনে তুলে ধরতেই শাওন পায়েসটুকু খেয়ে নিয়ে চারুর দিকে রোমাঞ্চকর দৃষ্টিতে তাকায়।

“জন্মদিন উপলক্ষ্যে পায়েস খাওয়াতে এই রাত্রিবেলা ছাঁদ অবধি টেনে আনলে?”

“শুধু পায়েস নয়। আজকে তোমাকে একটা বড়সড় উপহার দিবো।”

কথাটা বলেই চারু কাছে এগিয়ে গেলো। শাওনের গলা জড়িয়ে ধরলো। মুখে হাসি নিয়ে বললো,

“বিনিময়ে তুমি কি দিবে?”

স্ত্রীর কথা শুনে শাওন মৃদু হেঁসে চারুর ললাটে পরম যত্ন অধর ছোঁয়ায়। আদর করে গাল দু’টো ধরতে যাবে এমন সময় শাওন উপলব্ধি করে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! নিশ্বাস আটকে যাচ্ছে যেনো! চোখ দু’টো বড়বড় করে চারুর দিকে তাকাতেই চারু বেশ শব্দ করে হেঁসে বলে,

“তোমাকে ছেড়ে একাকিত্ব সহ্য করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তোমারই পাশে অন্য নারীকে সহ্য করতে পারলাম না!”

কথাগুলো বলতে বলতে শাওন ততক্ষণে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েছে। চারু মাটিতে বসে শাওনের পাশে। কিছুটা নুইয়ে শাওনের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“তোমায় বড্ড ভালোবেসেছিলাম বিনিময়ে তুমি আমাকে তিনটে বছর একাকিত্ব আর কষ্ট দিয়েছো! সবসময়ই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছো। বিয়ের এক সপ্তাহ আমার সাথে সময় কাটিয়েছিলে তারপর শুরু হলো তোমার ব্যস্তময় জীবন। নতুন বিয়ে করা সত্ত্বেও স্বামীর সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়নি আমার! না কখনো আঁধার রাতে তোমার কাঁধে মাথা রেখে গল্প করার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তুমি কেবল টাকা টাকা করে গেলে! আমাদের ভবিষ্যৎ করতে হবে, বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে৷ সংসারে নাকি তা প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। অথচ আমি একটু সময় চেয়েছিলাম যে সময়টুকু তুমি শুধু আমাকে দিবে। তার জন্য টাকা লাগতো না শাওন! আমি তো তোমার সঙ্গই পেতে চেয়েছিলাম। তুমি দাওনি! আমার কোনো ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করোনি। শুধু সারাদিন অফিস আর দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে রাত্রিবেলা ঘুমানোর জন্য বাড়িতে থাকতে। রাত্রিবেলা ওই কয়েকটা ঘণ্টা তোমায় পেতাম। সারাদিন হাপিত্যেশ হয়ে বসে থাকতাম। কত রাত চোখের জলে বালিশ ভিজিয়েছি তোমারই পাশে শুয়ে তুমি টেরও পাওনি। তাও আমি মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমিও চাইতাম তুমি বড় হও। কিন্তু এতোটা চাইনি যে তুমি আমাকেই ভুলে যাও! এতসব মেনে নিয়েও ছিলাম কিন্তু নিজের স্বামীকে অন্য নারীর সাথে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার ছিলো না। নিশিকে নিয়ে আগ থেকেই সন্দেহ ছিলো। আজকে পুরোপুরি নিশ্চিত হই যখন রুমে তোমাকে আর ওকে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়তে দেখি। আর সহ্য করতে পারিনি! একদিন জানতে পারি তোমার ছোটো চুল পছন্দ সে মোতাবেক নিজের অতি সাধের চুলগুলোও কেটে ফেলি যাতে তোমার নজরে আসি। তবুও তুমি আমাকে নিয়ে বেখেয়ালি ছিলে! দিনশেষে একাকিত্ব আর সর্বশেষে তোমার পরকীয়া কোনোটাই মানতে পারছিলাম না। তাই তোমার জন্মদিনেই তোমাকে ছুটি দিয়ে দিলাম। আমিও মুক্তি পেয়ে গেলাম রোজ রোজ তোমার শূণ্যতায় বেঁচে থাকবার চেয়ে!”

কথা গুলো বলে চারু নিশ্চুপ ভাবে বসে রইলো শাওনের নিথর শরীরটার পাশে। শাওন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে আরো আগেই। চারু অতি যত্নসহকারে মৃত স্বামীর মুখখানা ধরলো আদুরে ভঙ্গিতে। শাওনের সারা মুখ চোখে অজস্র চুমু এঁকে দিলো। মাথায় হাতও বুলিয়ে দিলো। মনে পড়ে গেলো বিয়ের প্রথম রাতের কথা। শাওন উঠবে না। আর কেউ সারাদিন একা রেখে রাত্রিবেলা এসে চারুকে বকবে না। আর কিছুই হবে না আগের মতন। সুন্দর স্মৃতি গুলো মনে পড়তেই নিশ্চুপভাবে কাঁদলো চারু। সুন্দর সব স্মৃতির সাথে নিশিকেও মনে পড়তেই চারুর চোখ মুখে আঁধার নেমে আসলো। রাগ হলো বড্ড! একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ভেতর থেকে। শেষবারের মতন শাওনকে দেখে নিয়ে তার দেহখানা টেনেটুনে ছাঁদের একদম কিনারায় নিয়ে আসলো। তারপর মৃতদেহটাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিলো! সকালে হয়তো সবাই ভেবে নিবে ছাঁদ থেকে পরে মারা গেছে শাওন। অন্তরালের সত্যি কি আদৌও কেউ জানতে পারবে? হয়তো না! নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে চারু ছাঁদ থেকে রুমে ফেরত যায়। রুমে যেতেই ড্রয়িং রুমে ইরিনকে বসা দেখতে পেয়ে ভড়কে যায়৷ ইরিন চারুকে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই জিগ্যেস করে,

“ভাইয়াকে রুমেও দেখতে পেলাম না। তুমিও ছিলে না। তোমরা কি কোথাও গিয়েছিলে দুজনে মিলে?”

“আমি তো নিচে গিয়েছিলাম। তোমার ভাইয়াকে দেখলাম ছাদে গেলো ফোনে কথা বলতে বলতে।”

“ওহ্। সারাদিন অনেক কাজ করেছো ভাবী। রেস্ট করো এবার।”

“তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো ইরিন।”

এই বলে চারু রুমে যায়। বেশ বুদ্ধি করে উত্তর দিলো ইরিনকে। যাতে ইরিন সকালে শাওনের লাশ দেখতে পেলেও সন্দেহ না হয়। ধরে নিবে রাতে ফোনে কথা বলতে বলতে শাওন অসাবধানতাবশত পড়ে গেছে! বেশ ভালোই হলো। নিজেকেই বাহবা দিতে লাগলো চারু। রুমে যেতেই বিষণ্নতা চেপে ধরলো তাকে! রুমের প্রতিটা কোনায় শাওনের অজস্র স্মৃতি।  এতো বছর একসাথে সংসার করেছে সে মানুষটাকে সে খুন করে আসলো? যতই একাকী থাক না এই সময়টা তো শাওন রোজ থাকতে চারুর পাশে। মুহুর্তগুলো মনে হতেই চারুর বুক ফেটে কান্না আসছে। আবার নিশির কথা মনে হতেই পাগলের মতন হাসতে থাকে। কষ্ট আর রাগ দু’টো  মিলিয়ে চারু যেনো পাগল হয়ে গিয়েছে একপ্রকার! আপাতত তাকে মানসিক রোগী বললেও ভুল হবে না!

এভাবেই আরো বেশ খানিকক্ষণ বসে থেকে চারুর নজরে যায় টেবিলে পড়ে থাকা শাওনের ফোনের দিকে। শাওন বেঁচে থাকতে কখনো চারুকে তেমন ফোন ধরতে দেয়নি। আজকে সে পৃথিবীতেই নেই। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে চারু ফোন হাতে নেয়। নিয়েই কল লিস্টে যায় তেমন কিছুই পায় না! তারপর মেসেঞ্জারে যেতেই চারুর চোখ পড়ে চ্যাট লিস্টে সবার আগে নিশির নাম। আবারো রাগ এসে জমা হলো। চ্যাটগুলো আরো কয়েকদিনের। আজকে শুধু নিশি অফিসের ব্যাপারে নক দিয়েছিলো যা শাওন সীনও করেনি। কৌতূহল বশত চারু সব চ্যাট পড়তে থাকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে বসে বসে।

____________________________

ঘুটঘুটে কালো নিকষ অন্ধকার। অন্ধকারের তীব্রতায় নিজের ছায়াও দেখা যায় না স্পষ্ট করে। এই সময় সবাই গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে। শুধু ঘুম নেই এক জোড়া চোখে। সে চোখ কেবল এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মাটিতে পড়ে থাকা তার মৃত স্বামীর দিকে। আশপাশে কতগুলো কুকুরের ডাকও শোনা যাচ্ছে বেশ ভয় ধরানো সেই ডাক। তাতেও  সেই মেয়েটির বিন্দুমাত্রও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেনো এভাবেই তার স্বামীর পাশে বসে আজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে, তাতে বিন্দুমাত্রও আপত্তি নেই মেয়েটির! বড্ড ভালোবেসেছিলো যে….

(পরিশিষ্ট- পরদিন সবাই শাওনের লাশ দেখতে পেলে চারু সবাইকে জানিয়ে দেয় সে নিজেই এসবের জন্য দায়ী। পুলিশ নিয়ে যায় তাকে। চার দেয়ালের মাঝে এখন চারুর দিন কাটে স্বামীর স্মৃতি নিয়ে। রাত্রে চারু যখন শাওন আর নিশির চ্যাট দেখে সেখানে স্পষ্ট ছিলো শাওন নিশির সাথে অফিসের দরকারি কথা আর সংসারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে গল্প করতো। যেখানে শাওন নিশিকে বেশ ভালোভাবেই চারুর কথা বলতো! একাকিত্ব আর হতাশায় সে ভেবেই নিয়েছিলো শাওন কোনো অন্য নারীতে আসক্ত। সেজন্যেই অফিস কলিগ থেকে শুরু করে ভার্সিটি লাইফের মেয়ে বন্ধুকেও সন্দেহের চোখে দেখেছে সর্বদা। মানতেই পারেনি ছেলে-মেয়ে নামক বন্ধুত্ব সম্পর্ক হতে পারে! নতুন বিয়ে হবার পর থেকে অতোগুলো দিন একা একা থাকতে থাকতে চারুর মনে শাওনকে নিয়ে সন্দেহের বীজ বপন হয়। যার ধ্বংস চারু নিজ হাতেই করলো! সব শেষ করে শেষ পথে আজ দাঁড়িয়ে আছে।)

সমাপ্ত। 

বি.দ্র. : এন্ডিং নেগেটিভভাবে না নেওয়া অনুরোধ রইলো। এমন অনেক মেয়েই আছে যারা বিয়ের পর স্বামী ছেড়ে একা থেকে আবার অবহেলা নিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। শুধু টাকার পিছনে সময় পার করলেই হয় না। জীবনকে উপভোগ করতে হয়। যে সময় একবার চলে যায় তা আর ফেরত আসে না!

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন