জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁকে কীভাবে সম্মান জানানো যায় তা নিয়ে ভাবছিলাম। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের সবক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতির জন্য বঙ্গবন্ধুর যা করেছেন তা অবশ্যই অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে তাঁর শিক্ষা নীতি আজকের আধুনিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটুক প্রযোজ্য তার একটি বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৭৩ সালের ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর শিক্ষাগত দর্শনের তিনটি দিক তুলে ধরেন। প্রথমত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষ জনশক্তির বিকাশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খেঁাজার চেয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ, এটি তাদের অন্যদের জন্য চাকরি তৈরি করতে সক্ষম করবে। তৃতীয়ত, কারিগরি শিক্ষা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত কারণ বর্তমান ব্যবস্থা কেরানি তৈরি করে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় বহুবার এর সমালোচনা করেছেন কারণ এটি দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে অক্ষম। আমরা আজকে আশ্চর্য হচ্ছি বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা নীতির উল্লেখিত তিনটি স্তম্ভ মানব সভ্যতার আজকের প্রেক্ষাপটে কতটা প্রাসঙ্গিক, যা তিনি পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে ভেবেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী ছিলেন? বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত—ই—খুদার নেতৃত্বে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬শে জুলাই একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশনের সুপারিশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে একটি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষা কমিশনের সুপারিশগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হয়নি। সমগ্র জাতি স্বভাবতই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। আমরা যুগ উপযোগী দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে পারিনি। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্তির চর্চা থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে। আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বাস করছি। এই শিল্প বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা এবং গবেষণার মাধ্যমে আমাদের প্রাত্যহিক সমস্যার সমাধান করে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা। এটা খুবই লক্ষনীয় যে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা নীতি এর তিনটি উল্লেখিত স্তম্ভই আজকের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূল চিন্তাধারার সাথে চমৎকারভাবে মিলে যায়। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬ সালে যখন ক্ষমতায় আসেন তখন অনেকগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিকল্পনা করেন। আমরা দেখতে পাই ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উক্ত পরিকল্পনায় বিচ্যুতি ঘটলেও গত ১৫ বছরে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় অনেকগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। শুধু তাই নয়, অনেকগুলো বিশেষায়িত যেমন মেডিকেল, মেরিটাইম ও এরনটিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মত তাঁর কন্যাও যথাযথ উপলব্ধি করেছেন যে উচ্চ শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া একটা জাতি কখনো উন্নত জাতি হতে পারে না। এমতাবস্থায়, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন। এই রূপকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের ২০৪১ সালে জিডিপির আকার হতে হবে ১.৬ ট্রিলিয়ন এবং মাথাপিছু আয় হতে হবে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে মাথাপিছু আয় হচ্ছে ২৭৯৩ মার্কিন ডলার এবং জিডিপির আকার হচ্ছে ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়েও অধিক। ২০০৮ সালে বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬০০ ডলার। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য, বিশেষ করে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার জন্য একটি অনন্য গবেষণা ও শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োজন যা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা নীতির তিনটি স্তম্ভ যথাক্রমে দক্ষতা, উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কারিগরি শিক্ষার যথাযথ সমন্বয় সাধন করতে পারে। এটি একাডেমীয়া ও শিল্পের কোলাবরেশনের মাধ্যমে হতে পারে। এই কোলাবরেশন তথা অ্যাকাডেমিয়া ও শিল্পের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণার ফলাফলের সাথে ইন্ডাস্ট্রির যথাযথ বাণিজ্যকরণের মাধ্যমে উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা আনয়ন সম্ভব। এভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার কেন্দ্রবিন্দু ও গবেষণার বাণিজ্যকরনের মাধ্যমে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় এক একটি অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হবে দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সিলিকন ভ্যালির বদৌলতে প্রতিনিয়ত দক্ষ জনশক্তি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি উদ্ভাবনী শিক্ষার ইকোসিস্টেম গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতির পিতার শিক্ষা নীতির তিনটি স্তম্ভকে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে এবং এভাবেই ১০৪তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারি। কারণ, এইধরনের একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে উপযুক্ত জ্ঞান দক্ষতা এবং উদ্ভাবন নিশ্চিত করবে। অবশেষে এটিই হয়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মূল চালিকাশক্তি।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন
অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উপদেষ্টা, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।