Site icon দৈনিক পূর্বদেশ | বাংলা নিউজ পেপার

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আলোচনা

নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জানতে চেয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতারা আজকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে বিএনপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের আলোচনা হয়।

বিএনপি: আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর বিগত রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলো এখনো প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। হাসিনার আমলে হওয়া রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রত্যাহারে বিলম্ব হচ্ছে।
সরকারের রেসপন্ড: পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস, তারপর সরকারি আইনজীবীদের অফিস নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়েছে মাত্র ৩ মাস হলো। এই ৩ মাসেই ৭ হাজারেরও বেশি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এবং প্রায় ১৬ হাজার মামলা লিস্টেড আছে। এগুলো দ্রুতই প্রত্যাহার হবে। কাজ চলছে। এরচে দ্রুতগতিতে মামলা প্রত্যাহার সম্ভব?
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুতই প্রত্যাহারে সরকারের আন্তরিকতা বুঝতে পেরে বিএনপির নেতারা মাথা নেড়ে সায় দেন।

বিএনপি: সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই বিএনপির প্রতিকূলে গেছে। তারপরও নীরব থেকে বিএনপি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে সরকারকে। বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও বিএনপির লোকদের কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সরকারের রেসপন্ড: তাৎক্ষণিক উদাহরণসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা দেখিয়েছেন সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বিএনপির অনুকূলে করা হয়েছে। যেখানে অন্যান্য অংশীজনের আপত্তি সত্ত্বেও। এবং কোথায় কোথায় বিএনপির লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা অবহিত করেন।
রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠই হলো বিএনপি সংশ্লিষ্ট।
(বিএনপি তখন বিগত ১৬ বছরে ধরে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম নিপিড়নের কথা বলেন। সরকার সংশ্লিষ্টরা তা স্বীকার করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও কৃতজ্ঞতা জানান।)

বিএনপি: শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা, যারা জুলাই গণহত্যা ঘটিয়েছে তাদের বিচার হচ্ছে না কেন?
সরকারের রেসপন্ড: বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত গতিতেই চলছে। আইসিটি আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। সরকার পূর্বে হাসিনার আমলে বিচার হওয়া মামলাগুলো সাথে কম্পেয়ার করে জানান এখন কোনো প্রক্রিয়ায় আছে। তাতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার কোনভাবে ডিলেই হচ্ছে না। আরও দ্রুত কার্যসাধন করতে তারা আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা সরকারকে জানিয়ে, সরকার সম্মতি দিয়েছে। শিগগিরই আরেকটা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। যাতে দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করা যায়।
কয়েকটি মামলার চুড়ান্ত তদন্তের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ট্রাইব্যুনালে এগুলো দাখিল করা হলে তখন জনগণের সামনে পরিষ্কার হবে কাজের অগ্রগতি।

বিএনপি: নির্বাচন নিয়ে অনেক উপদেষ্টার কথাবার্তার মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। তাদের অনেকের বক্তব্য প্রধান উপদেষ্টার কথার সাথে সাংঘর্ষিক। তারা সামনে আনেন সম্প্রতি একজন উপদেষ্টার বক্তব্য, ‘জনগণ এই সরকারকে ৫ বছর চায়…’
সরকারের রেসপন্ড: প্রধান উপদেষ্টা তাঁর মুখ দিয়ে যে কথা বলছেন, সেটাই মূল কথা। এই কমিটমেন্ট বাস্তবায়ন করা হবে। এর বাইরে কোনো উপদেষ্টা ব্যক্তিগত মত দেন বা বেফাঁস কথাবার্তা বললেও, সেসব কথা আমলে নিয়ে বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচন ডিসেম্বর ২৫ থেকে জুন ২৬ এর মধ্যেই হয়ে যাবে। এর বাইরে উপদেষ্টারা ভিন্ন চিন্তা করার সুযোগ নাই। কাজে বিএনপি বিভ্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নাই। আবার আশ্বস্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা।

বিএনপি: পরিষ্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে আপত্তি কোথায়?
সরকারের রেসপন্ড: ডিসেম্বর থেকে জুন বলা হয়েছে মানে এই নয় যে, আমরা ডিলেই করে জুন পর্যন্ত নিয়ে যাব। জুন পর্যন্ত থেকে যাব কালক্ষেপণ করে, এমন নয়। আমাদের মূল লক্ষ্য ডিসেম্বরে নির্বাচন করা। কোনো কারণে ডিসেম্বর সম্ভব না হলে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারী যাবে। এভাবে চিন্তা করেই আমরা বলছি ডিসেম্বর থেকে জুন৷ এটার মানে এই নয় যে, আমরা জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করে নির্বাচনের দিকে যাব। আপনারা পরিষ্কার থাকুন আমরা কথার বাইরে যাব না।
(আমাদের দল সংস্কারপন্থি। আমরা আগে থেকেই সংস্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করছি জনগণের কাছে। উপদেষ্টা এবং সরকারের সংশ্লিষ্টরা এগ্রি করেন বিএনপির এই বক্তব্যের সঙ্গে।)

বিএনপি: এখন সংস্কারের যে বিষয়গুলোতে অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য হচ্ছে, সেগুলো চার্টার করে সংস্কার হোক। বাকিগুলো নির্বাচিত সরকার আসলে, তারা সব অংশীদারের সাথে আলাপ-আলোচনা করে এগোবে। কী প্রয়োজন না-প্রয়োজন!
সরকারের রেসপন্ড: সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো দেওয়া হয়েছে সব দলকে। সেখানে কারা কতটা সংস্কারপ্রস্তাবনায় একমত হয়েছে, আংশিক একমত হয়েছে, এবং একমত নয় – সেসব ঐকমত্য-কমিশনের সাথে দলগুলোর সবশেষ মিটিংয়ে চুড়ান্ত হয়ে গেলেই আমরা ‘জুলাই সনদ’ নামে চার্টার করে ফেলব। সেখানে জনগণ পরিষ্কার দেখতে পারবে কোন দল কতটা বিষয়ে সংস্কার চাচ্ছে, কত বিষয়ে চাচ্ছে না এবং কোনো পদ্ধতিতে সংস্কারে পক্ষে মত দিচ্ছে। সবকিছু স্পষ্ট থাকবে, সেখানে সাইন করবে রাজনৈতিক দলগুলো।

নির্বাচন প্রসঙ্গে ফিরে বিএনপি

বিএনপি: প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ডিসেম্বরে নির্বাচন করা তো অসম্ভব নয়। কেন কালক্ষেপণ করা হচ্ছে!
সরকারের রেসপন্ড: ঐকমত্যের পর জুলাই চার্টার তৈরি হয়ে গেলেও সংস্কারের আইনগত ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে কিছু সময়ের প্রয়োজন আছে। কিছু কিছু সংস্কার বাস্তবায়ন করতে মাসেরও প্রয়োজন হবে। আলোচনায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। যেমন: একটি উদাহরণ দিয়েছেন, ডিজিটাল সুরক্ষা আইন করতে ২৩ বার ড্রাফট করা লেগেছে অংশীজনদের মত নিয়ে। বারবার করে বসতে হয়েছে অংশীদারদের সঙ্গে, তাদের মতামত নিতে হয়েছে। কয়েক মাস লেগেছে এটি করতে৷ ফলে, কোনো সংস্কার প্রস্তাবনায় ঐক্যমতে পৌঁছে গেলেই কাজ শেষ তা ত নয়, আইনগত ও নীতিগত দিক থেকে বাস্তবায়ন করতে সময়েরও ব্যাপার আছে।

আর এ সরকারের ওপর বড় দায়িত্ব জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা। জনগণের সবচে বড় আকাঙ্খা যেন আমরা (সরকার) জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার করে যাই। কোনো বিচারই যদি আমরা করে না যেতে পারি, আমরা নিজের বিবেকের কাছে কী জবাব দেব! দেশের মানুষের কাছে আমাদের জবাব দিতে হবে না? এত এত ছাত্র-জনতার জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের রক্তের ওপর দিয়ে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমরা এর বিচার নিশ্চিত করে যেতে হবে না?

সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এসবগুলোই আমাদের জন্য প্রায়োরিটির বিষয়। আমরা কথার বাইরে যাব না। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। জোর দিয়ে বলা হয়, আপনাদের আবার পরিষ্কার করছি, জুন পর্যন্ত টাইম দেওয়া মানে এই না যে, আমরা শেষটা ধরে এগোবো। আমরা ডিসেম্বরে নির্বাচন করার লক্ষ্যেই সব কাজ করছি। কোনো কারণে ডিসেম্বরে সম্ভব না হলে জানুয়ারি, বা ফেব্রুয়ারী। সে কারণেই এই টাইমলাইন দেওয়া। ডিসেম্বর ২৫ থেকে জুন ২৬। আপনারা নিশ্চিত থাকেন এরমধ্যে নির্বাচন হবে।

আলোচনা শেষে যমুনা থেকে বেরিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব ক্যামরার সামনে গিয়ে বলেন, ‘আমরা একবারেই সন্তুষ্ট নই। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের কোনো সুনির্দিষ্ট ডেডলাইন জানান নাই।’

এভাবে ক্লিয়ারলি প্রতিটি জিজ্ঞেসায়-উত্তর দেওয়ার পরও যদি বিএনপি নেতারা ক্যামরার সামনে গিয়ে বলেন, আমরা সন্তুষ্ট নই। তাহলে সরকার আর কীভাবে উত্তর দিলে তারা সন্তুষ্ট হবেন। আমার বুঝে আসে না!
এটা কী কোনোভাবে সম্ভব যে, সরকার ৯/১০ মাস আগেই সুনির্দিষ্ট করে বলে দেবেন ডিসেম্বরের এত তারিখ নির্বাচন!

এখনো প্রস্তাবিত কোনো সংস্কার কাজ শুরু হয় নাই, লীগের সাঙ্গপাঙ্গদের বিচারে কোনো মামলার রায় হয় নাই। যাদের বিরুদ্ধে এতো বড় একটা গণঅভ্যুত্থান করে আমরা বিজয়ী হয়ে এই সরকারের হাতে দেশের দায়িত্বের ভার তুলে দিলাম আপামর জনতা; সেই পরাজিত শক্তি, যাদের হাতে আমাদের ভাই-বোন, বন্ধুদের রক্ত লেগে আছে, তাদের বিচার নিশ্চিত করে সরকারকে যেতে হবে না?

নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এত শক্ত করে কমিটমেন্ট দেওয়ার পরও কেন বিএনপির কাছে ধোঁয়াসা রয়ে গেল। তারা সন্তুষ্ট হতে পারল না!

Exit mobile version