প্রায় তিন দশক আগে, ১৯৯৫ সালে মহারাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন দুই হিন্দুত্ববাদী দল—শিবসেনা এবং বিজেপি। মুম্বাইতে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেন শিবসেনার নেতা মনোহর জোশী। তবে, সরকারের আসল নিয়ন্ত্রণ ছিল শিবসেনা সুপ্রিমো বালাসাহেব ঠাকরের হাতে। বিজেপি-শিবসেনা সরকার মুম্বাই ও শহরতলির বস্তি এলাকাগুলোতে শুরু করে ‘বাংলাদেশি খেদাও’ অভিযান। পুলিশের তৎপরতায় বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের তুলে নিয়ে কলকাতাগামী বোম্বে-হাওড়া মেলের কামরায় পাঠানো হতে লাগল।
অভিযুক্তদের নাগরিকত্ব যাচাই ছাড়াই তাদের ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো, ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বাঙালি মুসলমানরাও অভিযানের শিকার হতেন। ভারতের কোনও রাজ্য সরকারের ডিপোর্ট করার ক্ষমতা নেই, তাই মহারাষ্ট্র সরকার এসব তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের রাজ্যছাড়া করেই দায় সারত।
হাওড়া স্টেশনে নেমে অনেকেই আবার জনারণ্যে মিশে যেতেন, কেউ কেউ রুটিরুজির খোঁজে মুম্বাইতে ফিরে আসতেন। বালাসাহেব ঠাকরের এই লড়াই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলছিল।
শেষ জীবনে যখন শিবসেনা ক্ষমতায় নেই, তখনও তিনি ‘মি মুম্বাইকার’ (আমরা যারা মুম্বাইয়ের) শ্লোগানে দলের সমাবেশে নিয়মিত বক্তৃতা দিতে যেতেন। তিনি শিবসৈনিকদের উদ্দেশে বলতেন, তানসা লেকের জল শুকিয়ে ফেলছে বাংলাদেশিরা। তানসা লেক মারা গেলে বাংলাদেশিরা পালিয়ে যাবে, কিন্তু মুম্বাইবাসীদের এখানেই থাকতে হবে—অতএব, এখনই তাদের তাড়াতে হবে।
দিল্লিতে অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান
মুম্বাইয়ের আগে, ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে একটি বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী হন মদনলাল খুরানা। হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে সংহত করার লক্ষ্যে বিজেপি শুরু করে প্রচার, অবৈধ বাংলাদেশি মুসলিমরা শহরের বিভিন্ন এলাকা ছেয়ে ফেলছে। তারা বাংলাদেশিদের তাড়ানোর জন্য একটি রাজনৈতিক অভিযান শুরু করে যার নাম দেওয়া হয় ‘ইলান-ই-জং’ (যুদ্ধ ঘোষণা)।
মদনলাল খুরানার সরকার অভিযানে ঢিলেমি করলেই বি এল শর্মা প্রেম হুঁশিয়ারি দিতেন, প্রয়োজন হলে মিলিটারি নামিয়ে বাংলাদেশিদের তাড়াতে হবে। রাজধানীতে যে কোনও ভোট এলেই এ ধরনের বক্তব্য ও অভিযানের দৌড় বৃদ্ধি পেত।
শরণার্থী বনাম অনুপ্রবেশকারী: একটি রাজনৈতিক ন্যারেটিভ
এর আগে, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আসামে ‘আসু’ ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতেও একটি বাংলাদেশি-বিরোধী মাত্রা ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই আচরণ ছড়িয়ে পড়ে। দিল্লি ও মুম্বাই থেকে শুরু হয়ে এধরনের আক্রমণ এখন ব্যাঙ্গালোর, আহমেদাবাদ, পুনে, জম্মু, লখনৌতেও দেখা যায়।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বিশ্লেষক রিজওয়ানা সামশাদ দেখিয়েছেন, ১৯৯০-এর দশক থেকে দিল্লিতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের উপস্থিতি কীভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নির্বাচনী প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গবেষণাপত্রের মূল বক্তব্য ছিল, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা হিন্দু বাংলাদেশিদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে দেখলেও মুসলিম বাংলাদেশিদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা আসার পর বাংলাদেশি-বিরোধী ক্যাম্পেইন একটি নতুন মাত্রা পায়, যেখানে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও যুক্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে এই বিষয়ে নীরব থাকলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্যে অবমাননাকর মন্তব্য করতে থাকেন।
বাংলাদেশি নাগরিকদের অবজ্ঞা: রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর ভারতের জনগণের মধ্যে যে উৎসাহ ছিল, মাত্র দুই দশকের মধ্যে সেই বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে অবজ্ঞার পাত্র হয়ে উঠলেন। ১৯৭১ সালে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বাংলাদেশের সম্মান জানানো হয়েছিল, কিন্তু আজ বাংলাদেশিরা কিভাবে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন?
ড. শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বাংলাদেশি বললে এখানে মুসলিম অভিবাসীদের বোঝানো হচ্ছে, যাদের সম্পর্কে আরএসএস-এর ধারণা হলো তারা ‘নো ডু-গুডার’। বিজেপির নেতারা বলেন, বাংলাদেশিরা যদি অবৈধ পথে ভারতে প্রবেশ করে থাকে, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নেতাদের বক্তব্য
বিজেপির এক নেতা অনির্বাণ গাঙ্গুলি বলেন, তারা বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের সম্মান করেন, তবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে তাদের আপত্তি আছে। তার মতে, বাংলাদেশি নাগরিক এবং অনুপ্রবেশকারীর মধ্যে একটি বিশাল পার্থক্য রয়েছে।
অন্যদিকে, কংগ্রেসের নেত্রী সুস্মিতা দেব মনে করেন, বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা নেহাতই ভোটের রাজনীতি। বিজেপি কিংবা অন্য কোনও দলই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।