নিয়োগের যোগ্যতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন ১২ বছর ধরে!
নিয়োগের যোগ্যতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন ১২ বছর ধরে!

এসএসসি পরীক্ষায় অঙ্কে “সি গ্রেড” এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজিতে “ডি গ্রেড” প্রাপ্ত ইউসুফ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে আবেদন করার যোগ্যতা হারিয়েছিলেন। কিন্তু বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তিনি গত ১২ বছর ধরে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। তার এই দীর্ঘ শিক্ষকতার বিষয়টি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।অভিযোগ ওঠে যে, ইউসুফ এসএসসিতে ৩.৫০ জিপিএ এবং এইচএসসিতে ৩.১ জিপিএ পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে, আবেদনকারীকে অবশ্যই এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষায় যেকোনো একটিতে জিপিএ-৪ (এ) পেতে হবে এবং স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে (ন্যূনতম ৩.৫) থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন উঠছে, নিয়োগ কমিটি কিভাবে ইউসুফকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল, যখন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এই শর্ত পূরণ করে না। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম রব্বানী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন, যাতে ইউসুফের নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

এই ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এ ধরনের বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অভিযোগকারীরা দাবি করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের প্রয়োজন, যাতে যোগ্য শিক্ষকদেরই শিক্ষকতা করার সুযোগ দেওয়া হয়।

এদিকে, ইউসুফের দীর্ঘ শিক্ষকতার বিষয়টি সামনে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তারা বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করতে পারে, যাতে নিশ্চিত করা যায় যে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা পুনরাবৃত্তি না ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে, যাতে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

এই পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে তাদের স্বচ্ছতা, ন্যায় ও যোগ্যতার মূল্যায়নের দিকে নজর দিতে হবে। ভবিষ্যতে শিক্ষকদের নিয়োগে যাতে যোগ্যতা এবং শর্তাবলীর পূর্ণ নিশ্চয়তা থাকে, সেই জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

 নিয়োগের যোগ্যতা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন ১২ বছর ধরে!
২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞপ্তি

তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে শিক্ষকতা থেকে তাকে আপাতত বিরত রাখার আবেদনও করেছেন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আলমগীর চৌধুরী লিখিত অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি ঢাকা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, পুরো বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে (বর্তমানে যার নাম দেওয়া হয়েছে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ) প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে একজনকে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। অন্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, প্ল্যানিং কমিটি গঠন না করেই শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়। যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির শর্তাবলির আলোকে আবেদনকারীদের যোগ্যতা যেন যাচাই-বাছাই করা না হয়; সে জন্যই প্লানিং কমিটি গঠন করা হয়নি। এই বিভাগে শুধুমাত্র একটি পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও বাছাই বোর্ড তিন প্রার্থীকে স্থায়ীভাবে নিয়োগের সুপারিশ করে- যা বেআইনি। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী ইউসুফের যোগ্যতা পূরণ না হলেও তাকে অন্যায়ভাবে ভাইবা কার্ড ইস্যু করা হয়। নিয়োগ বাছাই বোর্ডে ছিলেন বেরোবির উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল জলিল মিয়াসহ পাঁচজন। বাছাই বোর্ডের সদস্যরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও ইউসুফকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেন।

ইউসুফ এসএসসিতে জিপিএ- ৩.৫০, এইচএসসিতে ৩.১ পেয়েছেন। এসএসসিতে অঙ্কে পেয়েছেন “সি” এবং এইচএসসিতে ইংরেজিতে “ডি” পাওয়া এই ব্যক্তি স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়েছেন। আবেদনকারীদের মধ্যে অনেক যোগ্য প্রার্থী থাকলে বাছাই বোর্ড সুপারিশ করেনি। শুধু তাই নয়, সুকৌশলে নিয়োগ বাছাই বোর্ড বেরোবি আইনের ২৯ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে একটি প্রভাষক পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও দুইজন এবং অধ্যাপক পদে একজনসহ তিনজনকে নিয়োগ করার সুপারিশ করে, যা বাস্তবসম্মত ছিল না।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ইতিহাস বিভাগে একটি স্থায়ী পদের কথা উল্লেখ থাকলেও তিনজনকে স্থায়ী পদে নিয়োগ করার সুপারিশ করা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। সুপারিশকারীরা উল্লেখ করেছেন, আবেদনকারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সাক্ষাৎকারে দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। মজার বিষয় হলো, নিয়োগদানের সুপারিশের সব লেখা টাইপ করা থাকলেও প্রভাষক পদে “এক” শব্দটি কলম দিয়ে কেটে “তিন” লিখে দেওয়া হয়- যা অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এ বিষয়ে অভিযোগকারী বেরোবির ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম রব্বানী ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “বেরোবির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন যোগ্যতাহীন ব্যক্তিকে কীভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো- এটা আমাদের শিক্ষক সমাজের জন্য লজ্জার। যে ব্যক্তি এসএসসি-এইচএসসির একটিতেও জিপিএ-৪ পাননি। শুধু তাই নয়, এসএসসিতে অঙ্কে সি, এইচএসসিতে ইংরেজিতে ডি পায়- তার শিক্ষকতা করার কোনো অধিকার নেই। সে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের নামে প্রতারণা করছে।”

তিনি অবিলম্বে তার নিয়োগ বাতিল এবং শিক্ষকতার দায়িত্ব থেকে সরানোর আবেদন করেছেন বলে জানান।

এই বিষয়ে ইউসুফ দাবি করেন, “নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শর্তাবলীর ঘ-তে বলা হয়েছে, ‘কোনো পরীক্ষায় বি গ্রেডের নিচে অথবা তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না’। এই অনুযায়ী আমি আবেদনের যোগ্য। সেজন্যই আমাকে বাছাই বোর্ড সুপারিশ করেছে।”

বিজ্ঞপ্তিতে শর্তাবলীর (গ) নম্বর শর্তে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যেকোনো একটিতে ন্যূনতম “এ” (৫.০০ পয়েন্ট ভিত্তিক গ্রেড সিস্টেমে সিজিপিএ/জিপিএ ন্যূনতম ৪.০) থাকতে হবে- এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা সার্কুলারের দুর্বলতা। এর দায় আমার নয়।”

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন