আলাউদ্দিন নাসিম, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ফেনী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ফেনীর রাজনীতিতে তাঁর পরিচয় ছিল ‘নিজাম হাজারীর অভিভাবক’ হিসেবে। নিজাম হাজারী, যিনি ফেনীর রাজনীতিতে প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব, তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে নাসিমের ভূমিকা ছিল বিশাল। আলাউদ্দিন নাসিম ছিলেন হাজারীর পৃষ্ঠপোষক এবং ফেনীতে তিনি নিজাম হাজারীর কাছে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। নিজাম হাজারী নাসিমকে সবসময় শ্রদ্ধার সাথে ‘অভিভাবক’ বলে পরিচয় করিয়ে দিতেন এবং এমনকি নাসিম ফেনী গেলে নিজাম পা ধরে সালাম করতেন। ফেনীর রাজনীতিতে নাসিমের প্রভাব এতটাই ব্যাপক ছিল যে, তাঁকে ‘ফেনীর অভিভাবক’ বলা হতো এবং জেলার অনেক জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা তাঁকে অনুগত ছিলেন। যদিও তিনি আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে ছিলেন না, তবুও তাঁর প্রভাব যথেষ্ট ছিল। নাসিমের রাজনৈতিক উত্থান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তিনি শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তাঁকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করতেন। বিভিন্ন মহলে তাঁকে শেখ হাসিনার ফান্ড ম্যানেজার হিসেবেও উল্লেখ করা হতো। শেখ হাসিনার প্রটোকল কর্মকর্তা থাকাকালে তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং ফেনী আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের উদ্যোগে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
২০০১ সালের পর জয়নাল হাজারী ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর, ফেনী আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের জন্য ২০০৮ সালে নাসিম নিজাম হাজারীকে সামনে নিয়ে আসেন। নিজাম হাজারীকে ফেনীর রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করতে নাসিম প্রশাসন ও দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করেন। তিনি নিজাম হাজারীকে জয়নাল হাজারীর বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং ফেনীর রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেন। ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে ফেনীর রাজনীতি ও প্রশাসনে তাঁর প্রভাব বাড়তে থাকে। তবে নাসিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয় যে, তিনি অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন ও পাচার করেছেন। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে জমা দেওয়া তাঁর হলফনামায় তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ১০৮ কোটি টাকার সম্পত্তি দেখিয়েছেন। যদিও স্থানীয়রা মনে করেন, আলাউদ্দিন নাসিম ও তাঁর পরিবারের দেশে-বিদেশে আরও বিপুল সম্পদ রয়েছে। ফেনীর জনগণের মাঝে তাঁর সম্পদ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু ভয়ের কারণে অনেকেই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না।
ফেনীর পরশুরাম এলাকায় নাসিম ও তাঁর পরিবারের অবৈধ কার্যকলাপও স্থানীয়দের মধ্যে আলোচিত। তাঁর ছোট ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এবং চাচাতো ভাই নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এই এলাকার চোরাচালানসহ অন্যান্য অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ আছে। তাঁরা পরশুরাম এলাকার বালুমহালসহ বিভিন্ন অবৈধ খাতও নিয়ন্ত্রণ করেন। এই পরিবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে এবং বিরোধীদের উপর অত্যাচার চালায়।
নাসিমের প্রভাব শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ফেনীর বিভিন্ন সরকারি জমি দখল করে নিজের সম্পত্তি গড়ে তোলেন। ২০১৭ সালে নাসিম কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় স্থানীয় কৃষকদের জমি নামমাত্র মূল্যে জোর করে নিয়ে নেওয়া হয়। জমির বাজারমূল্য না দিয়ে অনেক কম টাকায় জমি দখল করা হয়। স্থানীয়রা ভয় পেয়ে এর বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস পান না এবং নাসিমের লোকজন লাল পতাকা টাঙিয়ে জমি দখল করে নেয়।
আলাউদ্দিন নাসিম এবং তাঁর পরিবার ফেনীর রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার হয়েছেন। স্থানীয় জনগণ তাদের অত্যাচার ও প্রভাবশালী দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। পরশুরাম এলাকায় তাঁর প্রভাবশালী বাহিনী রয়েছে, যারা মূলত চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এই বাহিনীর হাতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলাউদ্দিন নাসিম ও তাঁর পরিবার আত্মগোপনে চলে যান। যদিও নাসিম দাবি করেন, তিনি কোনো অবৈধ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না, এবং নিজাম হাজারীর উত্থানের পেছনে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই। তাঁর দাবি, তিনি ২০১২ সালের পর থেকে ফেনীর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না এবং ফেনী-১ আসনে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে প্রার্থী হন। জমি দখল করে কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তিনি দাবি করেন, জমিগুলো অনাবাদি ছিল এবং স্থানীয়রা স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছেন।
ফেনীর রাজনীতিতে নাসিমের দীর্ঘ প্রভাব ও আধিপত্য স্থানীয় জনগণের মাঝে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও, তিনি ফেনীর রাজনীতিতে একজন প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে থেকে যান।