জুলাই মাসে সংঘটিত ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দেশের সকল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা দ্রুত পূরণ না হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কার্যক্রমে এক প্রকার স্থবিরতা নেমে আসে। শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ, নীতিনির্ধারণ, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা উন্নয়ন কার্যক্রম সবখানেই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

এই সংকট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রবিধানমালা ২০২৪’-এর ৬৪(৩) ধারার আলোকে অ্যাডহক কমিটি গঠনের নির্দেশনা জারি করে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এসব কমিটি আগামী ছয় মাসের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পদক্ষেপ নেবে- এমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ অ্যাডহক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য ও দলীয় পরিচয়কেই মূল বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই প্রবণতা পূর্বতন সরকারের সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিকীকরণেরই এক প্রকার ধারাবাহিকতা বলে অনেকে মনে করছেন।

প্রশ্ন উঠছে, যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিগত দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পরিবেশকে কলুষিত করেছে, তারা কী করে এত দ্রুত সকল সমস্যা নিরসন করে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উদার, নির্মল ও অনুপ্রেরণামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে? শিক্ষা ব্যবস্থায় যখন দূরদর্শিতা ও নৈতিকতার পরিবর্তে দলীয় স্বার্থ ও প্রভাব মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়।

আমরা ভুলে যেতে পারি না যে, একটি জাতির প্রকৃত উন্নতি শুরু হয় তার শিক্ষা খাতের উত্তরণ ও শুদ্ধতার মধ্য দিয়ে। এই শুদ্ধি শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং নীতিনৈতিকতা, গুণগত শিক্ষা ও শাসনপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতায় নিহিত। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও অযোগ্য নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গড়ে তুলতে হবে আদর্শ, জ্ঞাননির্ভর ও মানবিক চেতনায় উদ্ভাসিত এক মহৎ ভিত্তি হিসেবে। এ দায়িত্ব কেবল সরকারের একক নয়, বরং একটি সচেতন, দায়িত্বশীল ও শিক্ষাবান্ধব জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসেই তা বাস্তবায়ন সম্ভব।

অতএব, সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও গোষ্ঠীগত প্রভাবের অবসান ঘটিয়ে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মাধ্যমে একটি দূরদর্শী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার। শিশুদের শৈশব হোক আনন্দময়, শিক্ষালয় হোক সৃষ্টিশীলতার সূতিকাগার, আর শিক্ষকেরা হোক জাতি গঠনের প্রকৃত কারিগর। তবেই গড়ে উঠবে এক আলোকোজ্জ্বল প্রজন্ম, যারা শুধু উন্নত বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে অবদান রাখবে।

টিপু সুলতান
লেখক ও গবেষক
ফোন: 01628749427

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন