বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার
বাহিনীর সদস্যরা নির্বিকার

শেখ হাসিনা সরকারের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পতনের পর রাজধানীতে একটি ছোট পরিসরের আন্দোলনে ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে দেখা যায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। রোববার কাকরাইলের অডিট ভবনের সামনে গ্রেড পরিবর্তনের দাবিতে অডিটরদের সড়ক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে এই ঘটনা ঘটে।

দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীনে কর্মরত দেড় থেকে দুইশ অডিটর সড়ক অবরোধ করে রাখেন। তাঁদের প্রধান দাবি ছিল, ১১তম গ্রেড থেকে তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা। এই অবরোধের ফলে কাকরাইলসহ আশপাশের এলাকাজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদলকে আলোচনার আহ্বান জানালেও তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যান।

যান চলাচল স্বাভাবিক করতে পুলিশ বারবার অনুরোধ করে আন্দোলনকারীদের সড়ক ছেড়ে এক পাশে অবস্থান নিতে। তবে তাঁরা তাতে কর্ণপাত করেননি। এক পর্যায়ে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে সরাতে “অ্যাকশনে” যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু অধস্তন কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা জটিলতা তৈরি করে।

দুপুর সাড়ে ১২টার আগে আন্দোলনকারীরা সিএজি কার্যালয়ের ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), সেনাবাহিনী এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা তাদের বাধা দেন। ফলে আন্দোলনকারীরা কার্যালয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন।

এরপর পুলিশ সাঁজোয়া যান আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং জলকামান নিয়ে আসে। বেলা দেড়টার পর রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. সারোয়ার জাহান হ্যান্ডমাইকে বারবার আন্দোলনকারীদের সড়ক ছাড়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু তাঁরা তা মানেননি। এরপর তাঁদের পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে সড়ক ছাড়তে বলা হয়। আন্দোলনকারীরা সরে না গেলে, পুলিশের সদস্যরা অডিট ভবনের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেন।

এ সময় ডিসি সারোয়ার অধস্তন পুলিশ সদস্যদের সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেন এবং হ্যান্ডমাইকে আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু রমনা জোনের এডিসি, এসি (পেট্রল) এবং রমনা থানার ওসিসহ কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ অধস্তন সদস্যদের নিষ্ক্রিয় দেখা যায়।

ডিসি সারোয়ার বারবার উপস্থিত ফোর্সকে সাহস জোগাতে চেষ্টা করেন, বলতে থাকেন, “সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুন।” কিন্তু অনেক কনস্টেবল ও উপপরিদর্শক (এসআই) সরাসরি জানান যে তাঁরা “অ্যাকশনে” যেতে পারবেন না। এই সুযোগে আন্দোলনকারীরা সড়কে দোয়া ও মোনাজাত শুরু করেন।

পুলিশ কর্মকর্তা সারোয়ার জাহান কয়েকজন কনস্টেবল ও এসআইকে জিজ্ঞেস করেন, ‘সাউন্ড গ্রেনেড মারতে পারো না তুমি?’ তখন তাঁদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি পারি না, স্যার।’ এপিবিএনের দলটির কাছে গিয়ে ডিসি সারোয়ার বলেন, ‘তোমরা কি আমার কথা শুনবা না?’ এ সময় এক এপিবিএনের একজন সদস্যকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা যেতে পারব না, স্যার।’ অনেকেই আবার নিজেদের মধ্যেও আলাপ করছিলেন, যেন কেউ সামনে না যায়। দুই এসআইকে কনস্টেবলদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘যা বলে বলুক, চুপ করে থাকো।’

এমন পরিস্থিতিতে কয়েক দফায় বিরক্তি প্রকাশ করতে শোনা যায় রমনার ডিসি সারোয়ার জাহানকে। সবশেষে আন্দোলনকারীদের সড়ক থেকে সরাতে নিজের ব্যর্থতার কথা মুঠোফোনে বলতে শোনা যায় পুলিশের রমনা বিভাগের ডিসিকে। তিনি তখন বলছিলেন, ‘স্যার, কেউ কথা শুনছে না। বারবার বলেছি, কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না।’

এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর কাকরাইলের সড়কের অবরোধ করা অংশে দেখা যায় ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) সানা শামীনুর রহমানকে। তবে তিনি আসার পরও অবরোধকারীদের সড়ক থেকে সরানো যায়নি।

বেলা ৩টা ১৭ মিনিটে আন্দোলনকারী অডিটরদের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে, তাঁরা সড়কের অবরোধ তুলে নিয়ে সেগুনবাগিচার দিকে চলে যাবেন। আগামীকাল (সোমবার) আবার তাঁদের কর্মসূচি পালন করা হবে। যদিও আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ তখন আবার বলছিলেন, এখনই না গিয়ে সড়কে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা চলে যাবেন।

এরই মধ্যে অডিট ভবনের সামনে উপস্থিত হন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার। তিনি এসে সব ফোর্সকে ডেকে একত্র করেন। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করেন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ধাক্কা দিয়ে সড়কের বাইরে নিতে থাকেন। তখন আন্দোলনকারীরাও তাঁর ওপর চড়াও হন। এ সময় উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের একটি অংশ এগিয়ে যায়। তখন আন্দোলনকারীদের বড় অংশ রাস্তা ছেড়ে দিতে থাকেন।
এ সময় সড়ক থেকে সরে না যাওয়া বাকি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে জলকামান থেকে গরম পানি ছোড়া হয়। তখন বাকিরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ডিসি পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা। যুগ্ম কমিশনার অতিরিক্ত ডিআইজি এবং অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের এই কর্মকর্তাদের কথা কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যায়ের সদস্যরাও কেন শুনছেন না—তা নিয়ে ঊর্ধ্বতন প্রত্যেক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে প্রথম আলো। তবে তাঁদের কেউই এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শুধু বলেছেন, ‘ঢাকায় পুলিশের অধস্তন পর্যায়ের সদস্যদের বড় অংশই শেখ হাসিনা সরকারের সময়ের। তাই তারা কথা শুনতে চায় না। অনেকে আবার ঢাকায় নতুন আসায় বিষয়গুলো বুঝে উঠতে পারে না। সব মিলিয়ে আমরা খুবই বিপাকে আছি।’

১টি কমেন্ট

রিপ্লাই দিন

আপনার কমেন্ট লিখুন
আপনার নাম লিখুন